মার্জিয়া আক্তার। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার আচারগাঁও ঝাউগড়া গ্রামে তার বাড়ি। বাবা আব্দুল মালেক মারা গেছেন ৩ বছর আগে। পরিবারে মা, দুই ভাই আর তিন বোন নিয়ে তাদের সংসার।
নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (কেবি) থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হন মার্জিয়া।
২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় ৭৫.২৫ স্কোর নিয়ে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও অর্থের অভাবে সেখানে তিনি ভর্তি হতে পারবেন কি না- এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তাকে অসহায় উপস্থাপন করে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরই এর সত্যতা নিয়ে স্থানীয়ভাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে এলাকায় চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন মার্জিয়া ও তার পরিবার।
এ বিষয়ে কথা হয় নান্দাইলের বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মার্জিয়ার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে। তারা জানান, মার্জিয়া অসহায় নন, তাদের পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল।
গ্রামের বাড়ি ছাড়াও নান্দাইল পৌর এলাকায় রয়েছে তাদের আরেকটি বাড়ি। সপরিবারে সেখানেই থাকেন তারা। এ ছাড়া মার্জিয়ার বড় ভাই রাকিবুল হাসানও পৌর এলাকার নামকরা ব্যবসায়ী। সেখানে তাদের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। নাম রাকিব বেকারি। বেকারির পেছনেই তাদের নিজস্ব বাসা। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি জায়গা, যার দামও অনেক। শুধু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে মাস শেষে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে তাদের পরিবার চলে অনায়াসে।
হাসিম উদ্দীন নান্দাইল উপজেলার চণ্ডিপাশা ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের তিনবারের সাবেক সদস্য। তিনি মার্জিয়ার আপন মামা।
হাসিম উদ্দীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বোনজামাই আব্দুল মালেক মারা গেছেন তিন বছর আগে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে মার্জিয়া তৃতীয়। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় ফল বেরোনোর পরই একজন সাংবাদিক তাদের বাড়িতে কথা বলতে আসেন। এর পরদিন পত্রিকায় নিউজ হলো, ‘মার্জিয়া আক্তার এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে ঠিকই, কিন্তু অর্থের অভাবে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তার বাবা মারা যাওয়ায় তারা অনেক অসহায় হয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সংবাদটি পত্রিকায় দেখেই সেই সাংবাদিকের বাড়িতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এই সংবাদ ছাপিয়েছেন কার অনুমতি নিয়ে? তখন তিনি আর কোনো কথা বলেননি।’
হাসিম উদ্দীন বলেন, ‘আমার বোনজামাই মারা গেছে বলেই তারা অসহায় হয়ে পড়েছে, বিষয়টি এমন না। আমার ভাগিনা প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। এলাকায় তার যথেষ্ট সুনাম আছে। এই অবস্থায় এমন সংবাদ প্রকাশে তারা বিব্রত হয়েছে।
‘তাছাড়া আর্থিকভাবে তারা সমস্যায় থাকলেও সহযোগিতার জন্য অন্য জায়গায় তাদের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না। কারণ আমরা এখনও বেঁচে আছি। আল্লাহ আমাদের সহযোগিতা করার সামর্থ্য দিয়েছে।’
এ বিষয়ে মার্জিয়ার বড় ভাই রাকিবুল হাসান মোবাইলে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই না।’
প্রকাশিত সংবাদটি সঠিক কি না এই প্রশ্নে, বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
নান্দাইল প্রেস ক্লাবের সভাপতি এনামুল হক বাবুল দৈনিক যুগান্তরের উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মার্জিয়াকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদটি সঠিক নয়। এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে মেয়েটিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে, সাংবাদিকতাকেও খাটো করা হয়েছে। অতি রঞ্জিত সংবাদ প্রকাশের কারণে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েটির বড় ভাই আমাকে ফোন করে এই সংবাদের প্রতিবাদ প্রকাশের অনুরোধ করেছিলেন।’
মার্জিয়া আক্তারকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সেই সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেন ওই প্রতিবেদক। সংবাদটি দেখে প্রতিবেদকের পোস্টে মন্তব্য করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন। মন্তব্যে তিনি লেখেন, ‘ধন্যবাদ আলম ফরাজি ভাই, আমি মেয়েটির সব দায়িত্ব নেব, যা যা প্রয়োজন সব করব, ইনশাআল্লাহ।’
সে পোস্টে নিউজের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। মন্তব্যের তোপের মুখে প্রোফাইল থেকে সংবাদটি সরিয়ে নেন ওই প্রতিবেদক।
শহীদ মুকুল নামে একজন পোস্ট করেন, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়া মার্জিয়ার পরিবার দরিদ্র নয়। কেন তার পরিবারকে দরিদ্র প্রমাণ করে সংবাদ প্রকাশিত হলো? সহযোগিতার নামে অপরাজনীতি হলো?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক যুবক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মার্জিয়া নিজের পাশাপাশি এলাকাকেও প্রশংসিত করেছেন। অথচ একজন সাংবাদিক নিজের প্রতি এমপি সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে মেয়েটিকেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিল। এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে৷’