‘তিন বছর আগেও বৈশাখের এক সপ্তাহ আগে থেকে দিনে তিন-চার মণ ইলিশ বেচছি। শেষবেলায় কাস্টমার বাজারে আইসা ইলিশ পাইত না। আর এবার তিন দিনেও এক মণ ইলিশ বেচতে পারি নাই। বড় ইলিশ তো দূরের কথা, ছোট ইলিশও মানুষ কিনতেছে না। পান্তা ইলিশও আর নাই, বাজারে ইলিশও কম।’
আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা মো. সালাম। তিনি বলেন, ‘ইলিশের আগের সেই বৈশাখী বাজার আর নাই। তবে দাম ঠিকই আগের মতো আছে। আমাগো বেশি দাম দিয়া কিইনা আনতে হইতেছে।’
ছবিটি সম্প্রতি যাত্রাবাড়ীর মাছের আড়ত থেকে তোলা - সাইফুল ইসলাম
একসময় রাজধানীসহ জেলা পর্যায়ের শহরেও বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ ছিল অন্যতম অনুষঙ্গ। দিনের শুরু হতো পান্তা ইলিশ দিয়ে। বাজারে ইলিশ কেনার এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হতো।
বাড়তি ইলিশের জোগান দিতে দেড়-দুই মাস আগে থেকে মাছ মজুত করেন ব্যবসায়ীরা। তারপরও মাছের চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেড়ে যেত। শেষ সময়ে অনেকটা কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।
গত দুই বছর করোনার কারণে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা ছিল না বললেই চলে। তবে এ বছর বাজারে ইলিশ আছে, দামে বৈশাখী উত্তাপও আছে, কিন্তু ক্রেতা নেই বললেই চলে।
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা সালাম বলেন, ‘মানুষ এখন ইলিশ মাছ খাওয়া ছাইড়াই দিছে। না হইলে তো এ সময় ভরপুর বেচাকেনা থাকত। বিভিন্ন পার্টি-মার্টি হইত, বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশের চাহিদাও থাকত।’
তিনি জানান, বাজারে এখন দুই ধরনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে অনেক আগের মাছ, যা দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিজিং করা। চোখ দেখতে একবারে নষ্ট। আর অন্যগুলো তাজা মাছ, চোখ এখনও তাজা, কানের নিচেও লাল।
বিক্রেতা সালাম বলেন, ‘তয় তাজা মাছ ওপরে রাখি না, নিচে ঝুড়িতে আছে, কেউ চাইলে দিই। ফ্রিজিং মাছের চাইতে কেজিতে ৪০০ টাকা বেশি দাম। এক কেজি ৩০০ বা ৪০০ গ্রাম ওজনের ফ্রিজিং ইলিশ বেচতাছি ১২০০ টাকা থেইকা ১২৫০ টাকা কেজি। কিন্তু তাজা নিলে কম কইরাও ১৬০০ টাকা কেজি দিতে অইব। তাজা মাছ বাজারে খুব একটা পাইবেন না।’
এ বছর বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ আছে, দামে বৈশাখি উত্তাপও আছে, তবে ক্রেতা নেই বললেই চলে। ছবি: সাইফুল ইসলাম
গত বছরের এ সময়ের চেয়ে এবার বড় ইলিশে কেজিতে ৩০০ টাকার মতো বেশি। গতবার বৈশাখের সময় এক কেজির ইলিশ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হতো বলে জানান সালাম।
কারওয়ান বাজারে মাছ বাজারের পুরোটাজুড়ে মাত্র চারজন বিক্রেতার কাছে ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে। তাদের একজন খোরশেদ আলম বলেন, ‘এখন ছোট মাছ ধরা বন্ধ। তাই বাজারে ছোট মাছও অনেক কম। মাস খানেক পরে মাছের জোগানও বাড়ব, দাম আরও কমব। এক কেজি প্লাস ইলিশের কেজি ১৩০০ টাকা। এক কেজির কম হইলে ১২০০ টাকা। আর দেড় কেজি হইলে ২০০০ টাকা কেজি। ১ কেজি ৭০০ থেকে ১ কেজি ৮০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ২২০০ টাকা বেচতাছি। তয় এত দাম দিয়ে সব কাস্টমার কিনতে পারে না।’
খোরশেদ বলেন, ‘বৈশাখে ইলিশের বেচাকেনা খুব খারাপ অবস্থা, যে দামে মাল (ইলিশ) ঘাডে কেনা পড়ে, তার অর্ধেকও কাস্টমার কয় না। ১৫ হালি মাছ আনছি, বেচছি দুই হালি। মানুষের কাছেও তো ট্যাকা নাই, কিনব কেমতে?’
এ বাজারে মো. মাসুদের কাছে পাওয়া গেল ছোট ইলিশ মাছ। মাসুদ বলেন, ‘দুই বছর ধইরা তো পহেলা বৈশাখই নাই। পান্তা ইলিশের দিনও গেছে গা। এখন যাগো টাকা আছে, তারাই ইলিশ খায়, যাগো নাই, তাগো অন্য মাছ। তবে আমার কাছে ইলিশ কম দামে আছে, মাছও তাজা। তিনটায় এক কেজি হইব, এ সাইজের ইলিশ ৪০০ থেকে ৪৫০ টেকা কেজি, দুইটায় এক কেজি হইব, এই সাইজের ইলিশের কেজি ৫৫০ থেকে ৬০০ টেকা। তিনটায় এক কেজি, কিন্তু আগের বরফ দেয়া মাছ আছে, ৩০০ টেকা কেজি।’
এ বাজারে মাছের ক্রেতা জালাল আহমেদ বলেন, ‘পান্তা ইলিশ তো খাই না, তিন-চার বছর আগে থেইকা পান্তা ইলিশের নাম ভুইলা গেছি। জিনিসপত্রের যে দাম, এখন ভাতের থালায় ইলিশ নাই, কিন্তু পান্তা ঠিক আছে। ছোট মেয়ে ইলিশ খেতে চাইছে, তাই বাজারে আইলাম। কিন্তু বড়গুলার দাম ম্যালা। দামে মিললে তিনটায় এক কেজি এমন সাইজের নেয়া যায় কি না দেখতাছি। না অইলে তো রুই মাছই ভরসা।’
আগে বৈশাখ এলে এলাকার বাজারগুলোতেও ভরা থাকত ইলিশ মাছে। এমনকি পাড়ায়-মহল্লায়ও ফেরি করে ইলিশ বিক্রি করত মাছ বিক্রেতারা। কিন্তু এবার তেমনটিও দেখা যাচ্ছে না।
বিজয় সরণি কলমিলতা বাজারে প্রায় সব ধরনের মাছ পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি ইলিশ। বিক্রেতা মনির বলেন, ‘ইলিশের কাস্টমার নেই বললেই চলে। আইজ ছোট ইলিশ পাই নাই, বড় ইলিশের দামও বেশি, বেচাও হয় কম। গত সপ্তাহে আইনা বেচতে কষ্ট হইছে। তাই আজ আনি নাই।’