আশা ছিল এই বৈশাখেই ফিরবে দিন। করোনার কারণে টানা দুই বছরের ক্ষতি কেটে যাবে এবারই। কিন্তু করোনা না থাকলেও এবারের বৈশাখ রমজান মাসে হওয়ায় মেলা জমেনি কোথাও।
শখের হাঁড়ির কারিগর সুশান্ত কুমারের তাই এবারও মন্দ ভাগ্য। বছরজুড়ে নানা রঙে ঢঙে বানানো তার শখের হাঁড়িগুলো পড়ে আছে বাড়িতেই।
রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগধানী বসন্তপুর এলাকার ‘ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি’ তৈরির কারিগর সুশান্ত কুমার পাল। তার বানানো হাঁড়ির পরিচিতি এখন দেশজুড়ে। শখের হাঁড়ি বানিয়ে অনেক পুরস্কারও জমেছে তার ঝুলিতে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
প্রতি বছর তাই বৈশাখ মাস আসার আগে থেকেই সুশান্ত পালের নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। বাড়িজুড়ে থাকে ব্যস্ততা। শুধু সুশান্ত নন, তার পরিবারের ছোট-বড় সবারই ব্যস্ততা বেড়ে যায় এই সময়টিতে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মৃতপ্রায় মৃৎশিল্প আঁকড়ে ধরে এভাবেই বেঁচে আছেন কারুশিল্পী সুশান্ত কুমার পাল। তার ভাই সন্তোষ পাল, স্ত্রী মমতা রানী পাল, ছেলে সঞ্জয় ও মৃত্যুঞ্জয়, মেয়ে সুচিত্রা এবং দুই ছেলের স্ত্রী মুক্তি ও করুণা রানী পাল, তাদের সবাই এখন কারুশিল্পী। তাদের বাড়িতে গেলে সারা বছরই দেখা যাবে শুধু হাঁড়ি আর হাঁড়ি। বাহারি এসব হাঁড়ির গায়ে নানা রঙের কারুকাজ।
সুশান্ত পালের তত্ত্বাবধানেই প্রতি বছরই তৈরি হয় হাজার বছরের পুরোনো শখের হাঁড়ি, পঞ্চসাঞ্জি, মাটির পুতুলসহ বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন তৈজস।
সুশান্ত জানান, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জের সোনার গাঁ জাদুঘর চত্বর, ঢাকার বাংলা একাডেমি চত্বর, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র এবং হাটকো স্কুলে মেলার আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার পদচারণ। কিন্তু টানা তিন বছর মেলা জমে না ওঠায় তার বাড়িতে এখন প্রায় ১০ হাজার হাঁড়িসহ অসংখ্য মাটির খেলনার স্তূপ জমেছে।
সুশান্তর মতো মন্দ কপাল রাজশাহীর বাকি শখের হাঁড়ির কারিগরদেরও। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসেই বাংলাদেশে প্রচলিত শখের হাঁড়ির অন্য নাম দাঁড়িয়েছিল- ‘রাজশাহীর শখের হাঁড়ি’। উৎসবপ্রিয় বাঙালির প্রতিদিনের জীবন, ধর্ম-সংস্কৃতি, আনন্দ-বেদনা এবং চিন্তার সঙ্গে শখের হাঁড়ি একাকার হয়ে আছে।
সুশান্ত বলেন, ‘এগুলো বিক্রি করেই আমার সংসার চলে। সারা বছরের উপার্জন হয় বৈশাখী মেলা থেকে। তবে অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে তাতে সারা বছর কী খাব তা নিয়েই এখন ভাবছি।’
এবারের বৈশাখে রাজশাহীতে কোনো আয়োজন না থাকলেও বর্তমানে ঢাকার একটি মেলায় অবস্থান করছেন সুশান্ত কুমার পাল। সেখানে শখের হাঁড়ির পসরা নিয়ে গেছেন তিনি। তবে সেখানেও হতাশ তিনি। রমজান মাসের প্রভাবে মানুষের উপস্থিতি নেই। দোকানে কেউ আসছেন না।
সুশান্ত জানান, গত তিন বছরে তার প্রায় ১০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। শত শত হাঁড়ি বস্তাবন্দি করে তুলে রাখা হয়েছে। এগুলোর দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা।
সুশান্ত বলেন, ‘শখের হাঁড়ি তৈরি আমার নেশা, আর বিক্রি আমার পেশা। বিক্রি না হলেও আমার শুধু নেশার তাগিদেই প্রতি বছরই আমি হাঁড়ি তৈরি করি।’
তবে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে গুনতে মনের জোর হারিয়ে ফেলছেন বলেও জানিয়েছেন এই শৌখিন কারিগর।