আসর নামাজ শেষেই ব্যস্ততা স্বেচ্ছাসেবকদের। ইফতারের থালায় কেউ দিচ্ছেন ছোলা, কেউ বা দিচ্ছেন খেজুর ও জিলাপিসহ আট রকমের খাবার। আরেকদিকে একদল ব্যস্ত লেবু আর রুহ আফজার শরবত বানাতে। নেই কোনো বিশৃঙ্খলা। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসতেই একে একে হাজির হাজারো রোযাদার।
এমন চিত্র চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। ২০০১ সাল থেকেই এভাবেই ইফতারের আয়োজন চলে আসছে সেখানে। তবে বড় আকারে মক্কা-মদিনার আদলে গণইফতারের শুরুটা ২০০৮ সালে। যার মূল উদ্যোক্তা এই মসজিদের খতিব হযরত ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হসাইন তাহের আল জাবেরী আল মাদানী।
প্রতিবছর রমজানেই এই মসজিদে চলে ইফতার তৈরির এমন মহাযজ্ঞ। যেখানে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবকের আন্তরিক সেবায় ইফতার করেন ২ থেকে ৩ হাজার রোযাদার। প্রথম রমজান থেকে শুরু হয় গণইফতারের এমন আয়োজন।
মাঝে করোনার কারণে গত দুই বছর এই আয়োজন বন্ধ ছিল। তবে এই বছর ফের শুরু হয়েছে এই ইফতার আয়োজন। যা রূপ নিয়েছে ঐতিহ্যে।
ধনী-গরিব এক কাতারে শামিল হয়ে অংশ নেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ঐতিহ্যবাহী এই ইফতারে। নানা শ্রেণি পেশার লোক আসর নামাজের পর থেকে ইফতারে শরিক হতে হাজির হন মসজিদে। গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি একই কাতারে শামিল হন সামর্থবানরাও। যা তাদের মনে এনে দেয় পরম শান্তি।
গত ৬ এপ্রিল বিকেলে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পূর্ব আকাশে সূর্য যখন ডুবি ডুবি, মসজিদের বারান্দায় তখন সারিবদ্ধভাবে ইফতারের অপেক্ষায় প্রায় দুই হাজার রোযাদার। কাতারে কাতারে ইফতারে শামিল হতে এসেছেন ছাত্র, ব্যবসায়ী,দিনমজুর, ভিক্ষুক, চাকরিজীবী সহ সমাজের প্রায় সব শ্রেণি পেশার মানুষ। তাদের সামনে থরে থরে সাজানো ইফতারের থালা। এক ছাদের নিচে,মেঝেতে বসে এমন ইফতার যেন বৈষম্যহীন সমাজের প্রতিচ্ছবি।
বছরের পর বছর এমন ইফতারের আয়োজনের বিষয়ে জানতে কথা হয় মসজিদের খতিবের ব্যক্তিগত সহযোগী মো হাসান মুরাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘২০০১ সাল থেকেই মূলত এই আয়োজনের সূত্রপাত। যা বড় আকারে শুরু হয় ২০০৮ সালে। আমাদের খতীব সাহেব মক্কা-মদিনার আদলে চট্টগ্রামেও এমন ইফতারের উদ্যোগ নিয়েছেন।
‘রমজানের প্রথম ১৫ দিন পর্যন্ত এখানে ২ থেকে ৩ হাজার মানুষের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। শেষ ১৫ রমজান পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষের ইফতারের বন্দোবস্ত করা হয়। এমন বিশাল আয়োজনে আমাদের এক টাকাও খরচ হয় না। মূলত বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ইফতারের খরচ নির্বাহ করে থাকেন। প্রতিদিন রোযাদারদের শরবতসহ ৯ ধরনের ইফতারি পরিবেশন করা হয়।পুরো কাজ সহায়তা করে ২০ জনের একদল স্বেচ্ছাসেবক।’
২০০৮ সাল থেকেই আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে বাবুর্চি হিসেবে ইফতার তৈরি করে আসছেন মোহাম্মদ ইয়াছিন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খতীব হুজুরের নির্দেশে আমরা মিলেমিশে সকাল থেকে ইফতার তৈরি করি। পারিশ্রমিক হিসেবে নির্ধারিত কিছু টাকা পেলেও এ কাজ করতে শান্তি লাগে। তাই রমজান এলেই সব কাজ বাদ দিয়ে এখানে চলে আসি। অচেনা অজানা রোযাদারদের ইফতার করাতে শান্তি লাগে। এ কাজ করতে গিয়ে ক্ষণিকের জন্যও ক্লান্তি লাগে না।’
রমজান এলেই মসজিদে ইফতার আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে হাজির হয়ে যান ৪৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ শহীদ আলম । পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেও ৮ বছর ধরে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত তিনি।
ইফতারের আগ মুহূর্তে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি বলেন, ‘এখানে কাজ করতে কোনো কষ্ট আর ক্লান্তি নেই। খতীব সাহেবের নির্দেশেই দোয়ার জন্য কাজ করতেছি। রোযাদারদের সেবা করতে পেরে আনন্দ লাগে।’
ব্যবসায়িক কাজে আন্দরকিল্লা এসে মসজিদে গণইফতারে শরিক হন পঞ্চাশোর্ধ্ব কিসমত আলী। মসজিদের অদূরেই দেওয়ানবাজার এলাকায় বাসা তার। তবুও বরকত লাভের আশায় শামিল হয়েছেন এখানে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এতো লোক এক সঙ্গে ইফতার করছি, এটা ভাল লাগে। ঘরে তো দুই একজন ছাড়া ইফতার করা হয়না। বেশি মানুষের সঙ্গে ইফতার করলে বরকত আর রহমত বেশি। আমরা সবসময় সব জায়গায় ইফতার করতে পারি। কিন্তু মসজিদে ইফতার করার মধ্যে আলাদা একটা বরকত আছে।’
এই মসজিদে প্রথমবার ইফতার করতে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জরুরিরী একটা কাজে আন্দরকিল্লায় আসি। কিন্তু ট্রেন মিস করায় ইফতার করতে এখানে চলে আসি। সব শ্রেণি পেশার মানুষ একসাথে ইফতার করতেছি এটা ভালো একটা মুহূর্ত কাটছে।’