হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্নবর্ণের লোকজনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কারণে বাগেরহাটের চিতলমারীর পাঙ্গাশিয়া গ্রামে সম্প্রতি এক হিন্দু পরিবারকে একঘরে করার অভিযোগ ওঠে। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে নিউজবাংলাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। প্রকাশিত সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সংবাদটি ফেসবুক পোস্টে অনেকে শেয়ারও করেন। সৌগত বোস নামে একজন সেটি শেয়ার করে ফেসবুকে লেখেন- ‘এরা মানুষ হবে না। সমাজপতি নাম নিয়ে মরে যাবে।’
রুম্পা রায় নামে আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী সেটি শেয়ার করে লেখেন, ‘পরিবারটি এখন বসতভিটা বিক্রি করে ওই এলাকা ছেড়ে অন্য গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে... সমাজপতিদের এসব নিয়ম আর কতদিন চলবে!’
বিষয়টি নিয়ে আরও অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। তবে প্রশাসনের কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঙ্গাশিয়া গ্রামের শিক্ষক সভারঞ্জন গুহ সমাজচ্যুতির যে অভিযোগটি করেছেন, তা মূলত প্রতিবেশীর বাড়ির একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াতবঞ্চিত হয়ে। গ্রামের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দাবি, সভারঞ্জনের পরিবারকে একঘরে করার ঘটনা ঘটেনি।
নিউজবাংলার প্রতিবেদক স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, পাঙ্গাশিয়া গ্রামটিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০ পরিবারের বসবাস।
গ্রামটি হিজলা ইউনিয়নের আওতাভুক্ত। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কাজী আবু সাহিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাঙ্গাশিয়া গ্রামে এক হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করেন। তাদের মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীও আছেন।’
হিন্দু বর্ণ প্রথা অনুযায়ী মতুয়ারা নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে তাদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা আছে।
ঘটনার সূত্রপাত
একঘরে হওয়ার অভিযোগটি তোলেন পাঙ্গাশিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল্পনা হালদার। তিনি স্থানীয় এক সাংবাদিককে বলেন, “গত ১৮ মার্চ পাঙ্গাশিয়া গ্রামের মতুয়া সম্প্রদায়ের কালিদাস মণ্ডলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে আমার স্বামী সভারঞ্জন গুহ অংশ নিয়ে অতিথি আপ্যায়নে সহযোগিতা করেন।
“এ ঘটনার জেরে ‘সমাজ ডেকে’ মুক্তবাংলা চারিপল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি গুহ আমাদের পরিবারকে একঘরে করার ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে তারা সমাজ থেকে আমাদের বাদ দিয়ে ৩০ মার্চ বাড়ির পাশে অন্নদা গুহর বাড়িতে বিশাল অনুষ্ঠান করেন।”
শিক্ষক আল্পনা হালদারের স্বামী সভারঞ্জন গুহ বলেন, ‘একজনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিবারকে সমাজ থেকে একঘরে করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর পর থেকে আমরা সামাজিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। বসতভিটা বিক্রি করে এই এলাকা ছেড়ে আমরা অন্য গ্রামে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি।’
যে কারণে দ্বন্দ্ব
নিউজবাংলার বিস্তারিত অনুসন্ধানে অভিযোগের আংশিক ভিত্তি পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, বর্ণগত বিভাজনের কারণে একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াত পায়নি ওই পরিবার। তবে তাদের একঘরে করা হয়নি।
ওই গ্রামের বাসিন্দা মতুয়া সম্প্রদায়ের সদস্য সৌম দীপ মণ্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় ও মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যে কারণে একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আরেকটি সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা অংশ নেয় না।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৮ মার্চ আমার বাবা কালিদাস মণ্ডলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সভারঞ্জন গুহসহ তার পরিবারকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তিনি আমাদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার একটি দ্বন্দ্ব শুরু হয়।’
ওই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়ার কারণে গ্রামের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আরেকটি অনুষ্ঠানে দাওয়াতবঞ্চিত হয় সভারঞ্জনের পরিবার।
সভারঞ্জন গুহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত ৩০ মার্চ আমার পাশের বাড়ি অন্নদা গুহর বাড়িতে বিশাল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে আমি বা আমার পরিবারের কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। একই বংশের লোক হওয়ার পরও আমার সঙ্গে এমন আচরণ করা হলো কেন? আমার বিপদ-আপদে তারা যে আসবে না, দাওয়াত না দেয়ায় তার প্রমাণ পেয়েছি।’
তার স্ত্রী শিক্ষক আল্পনা হালদার বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী গুহ বংশের লোকজন আমাদের বাড়িতে আসছে না। তাদের কোনো অনুষ্ঠানে আমাদের দাওয়াতও দিচ্ছে না। পরিস্থিতি এখন এমন যে নিজ বংশের লোক হয়েও আমাদের বিপদ-আপদে তারা কেউ এগিয়ে আসবে না।’
এ বিষয়ে সভারঞ্জনের প্রতিবেশী গুহ পরিবারের সদস্য অনাদি গুহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু রীতিনীতি আছে। সভারঞ্জন গুহকে আগেও সেগুলো মেনে চলতে বলা হয়েছে। তবে তিনি তার মতো করে চলছেন। আমাদের যে রীতিনীতি আছে, সেই রীতিনীতি অনুযায়ী যারা চলে, সামাজিক যে আচার-অনুষ্ঠান আছে, তাতে তাদের নিমন্ত্রণ করা হয়। এ ছাড়া যারা রীতিনীতি মানে না, তাদের নিমন্ত্রণ করা হয় না।
‘আমাদের বাড়িতে একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের (নামযজ্ঞ) আয়োজন করা হয়, যেখানে সভারঞ্জন গুহকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। বিষয়টি এমন নয় যে শুধু তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। অনেককেই ওই অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয়নি। তার মানে এই না যে, তাদের একঘরে করা হয়েছে।’
সভারঞ্জন গুহের আরেক প্রতিবেশী অমল গুহ বলেন, ‘সভারঞ্জন গুহকে সমাজচ্যুত করা হয়নি। মূলত সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সামাজিক যে ক্রিয়াকলাপ, তারা তা অমান্য করে চলছে। সামাজিকভাবে মিটিং করে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা তারা মেনে নেয়নি। তার পর থেকেই গ্রামের বিভিন্ন সমাজিক অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত না দেয়া শুরু হয়েছে।’
বহুকাল ধরে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনকে প্রধান হিসেবে মানা হয়। তাকে বলা হয় সমাজপতি। বর্তমান সমাজপতি হলেন মুক্তবাংলা চারিপল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি গুহ।
মৃণাল কান্তি বলেন, ‘হিন্দু ধর্মে বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। যেমন মাথা মুণ্ডন করা, তুলসীতলায় জল দেয়াসহ নানা বিষয় রয়েছে। কিন্তু মতুয়া সম্প্রদায়ের কিছু লোক এই রীতিনীতি মানতে নারাজ। এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব চলছে।
‘সম্প্রতি ওই সম্প্রদায়ের কালিদাস মণ্ডল মারা গেলে তার সন্তানরা এই রীতিনীতি পালন করেনি, যে কারণে কালিদাসের শ্রদ্ধানুষ্ঠানে আমরা কেউ যাইনি। তবে আমাদের সম্প্রদায়ের সভারঞ্জন গুহ সপরিবারে সেখানে গিয়েছিলেন। এরপর আমাদের সম্প্রদায়ের একটা অংশ মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়, সভা রঞ্জনসহ যারাই আমাদের রীতিনীতি মেনে চলবে না, তাদের সঙ্গে আমাদের সামাজিক সম্পর্ক থাকবে না।
‘তবে সভারঞ্জনের বিষয়ে যেটি বলা হচ্ছে, তাকে একঘরে করা হয়েছে। সেটা সত্য নয়। সবাই মিলে সামাজিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেখানে সভারঞ্জনও উপস্থিত ছিলেন। এরই জেরে গ্রামের গুহ বংশের পরিবারগুলো রঞ্জন গুহর সঙ্গে তাদের সামাজিক দূরত্ব তৈরি করেন। সেটাকে তো আর একঘরে করা বলে না। গুহ বংশের লোকজন ছাড়া গ্রামের অন্য সবার সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।’
সভারঞ্জন গুহের প্রতিবেশী নির্মল চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সোভাদাকে একঘরে ঘোষণা দেয়ার পর গুহ বংশের কেউ তার বাড়িতে যাতায়াত না করলেও আমিসহ অন্য পরিবারের লোকজন সবাই তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। বিপদে তার পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা হিন্দু সম্প্রদায় লোকজন মিলেমিশে এই গ্রামে বসবাস করছি। আগে আমাদের মধ্যে এ ধরনের বিরোধ কখনও হয়নিই বলেই জানি।’
হিজলা ইউনিয়নের এই পাঙ্গাশিয়া গ্রামে মোট হিন্দু পরিবারের সংখ্যা ১০৮টি। গ্রামটিতে মতুয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ ছাড়া আছেন মাঝি, বাড়ই, চৌধুরী, হালদার ও গুহ বংশের লোকজন।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কাজী আবু সাহিন জানান, গ্রামটিতে ২৫টির মতো গুহ পরিবারের বসবাস। ধর্মীয় আচার পালন নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। পরে তা মীমাংসাও করা হয়েছে।
যা বলছে প্রশাসন ও পুলিশ
চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইয়েদা ফয়জুন্নেছা বলেন, ‘একঘরে বলতে আমরা যা বুঝি, এ ঘটনাটি তেমন নয়। মূলত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের যাওয়ার পর সভারঞ্জন গুহকে তার প্রতিবেশীরা নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেয়ার কারণে তিনি অভিযোগ করছেন তাকে একঘরে করা হয়েছে।
‘এ ছাড়া আমি বিষয়টি তদন্ত করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, তিনি আমাকে জানিয়েছেন ধর্মীয় রীতিনীতি পালন নিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।’
তিনি জানান, দুই পক্ষের উপস্থিতিতে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে। সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা মিলেমিশে বসবাস করবেন।
চিতলমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশনায় ঘটনাস্থলে থানা থেকে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোয় তারা আগের মতোই অংশগ্রহণ করবেন বলে আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’