বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাসাবোর বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় সম্প্রীতির ইফতার

  •    
  • ১০ এপ্রিল, ২০২২ ২১:৪১

পিয়ারু বেগম বলেন, ‘আমার অর্থ সম্পদ নাই। ভিক্ষা কইরা খাই। ইফতার নিতে আইছি। হেরা দুই তিন বছর আগে আমারে চাইল, তেল, সেমাই, চিনি, শাড়ি দিছে আমি হেগোতা খাইছি।’

নদী ভাঙনে হারিয়েছেন বসত ভিটে; হয়েছেন সহায় সম্বলহীন। দিন বদলের আশায় ফরিদপুর ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন ঠিকানাবিহীন নারী পিয়ারু বেগম। রাজধানীর বাসাবোতে কোনো মতে টিকে আছেন তিনি। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই পেটে জুটে আহার।

৫৫ বয়সী এই নারী বিকেল সাড়ে ৪টায় বাসাবোর ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন। অন্যদিকে সমানতালে বাড়ছে ঘড়ির কাঁটা। সময় যত ছুটছে, পিয়ারু বেগম, মজিদ মিয়াসহ শাহানা বেগমদের লাইন দীর্ঘ হচ্ছিল বিহারের সামনে।

সবার একটাই উদ্দেশ্য, সারাদিন রোজা রেখে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের ইফতার।

ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ। সংগঠনটির উদ্যোগে রাজধানীর বাসাবো ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার প্রাঙ্গণে ২০১৩ সাল থেকে রমজান মাসে দরিদ্র্য রোজাদারদের মাঝে এই ইফতারি বিতরণ করে আসছে।

করোনাভাইরাস মহামারির গত দুই বছর এই কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও এ বছর থেকে আবার শুরু হয়েছে ইফতারি বিতরণ। প্রতিদিন প্রায় ২০০ রোজাদারকে ইফতারের ব্যবস্থা করা হয় সেখানে।

করোনার আগে আয়োজন করা হতো তিন থেকে পাঁচশ লোকের ইফতার। সবুজবাগ বাসাবো রোডে অবস্থিত হারুন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে কেনা হয় খাবার। ইফতারি হিসেবে ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি, আলুর চপ, মুড়ি থাকে।

রোববার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার প্রত্যাশী লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই বাসাবোর দিনমজুর, রিকশাচালক, ছাত্রসহ নিম্ন আয়ের মানুষেরা।

কেউ নিয়ে এসেছেন সন্তানকে কেউ আবার নাতি-নাতনিকে। অন্যপাশে থরে থরে সাজানো ইফতারি। বেলা ৫টা ৩০ মিনিটে সবার মাঝে শুরু হয়ে ইফতারি বিতরণ।

বৌদ্ধ বিহারের ইফতার পাওয়া পিয়ারু বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার অর্থ সম্পদ নাই। ভিক্ষা কইরা খাই। ইফতার নিতে আইছি। হেরা দুই তিন বছর আগে আমারে চাইল, তেল, সেমাই, চিনি, শাড়ি দিছে আমি হেগোতা খাইছি।’

কথাগুলো যখন তিনি বলছিলেন তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তিনি।

বৌদ্ধ বিহার থেকে পাওয়া ইফতারে তার আনন্দ হয় জানিয়ে বলেন, ‘হেগো ধর্মের মানুষগুলান খুব ভালা।’

ময়মনসিংহের মজিবুর রহমান পেশায় রিকশাচালক। বাসাবোর আহমদবাগের বাসিন্দা তিনি। করোনার আগে থেকেই প্রতিবছর তিনি ও তার স্ত্রী এখান থেকেই ইফতারি খেয়ে আসছেন। হিন্দু-মুসলিম সবার লগে আছি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে ইফতার নিতাছি। ভালাই লাগে, প্যাকেটের গায়ে তো নাম লিহা নাই।’

ধর্মরাজিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রাব্বি হোসেন। বাবা মা নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকে বাসাবো এলাকায়। বাবা পেশায় অটোরিকশার মিস্ত্রী। এ বছর প্রতিদিনই এখানে এসেই ইফতারের প্যাকেট নিয়ে যান রাব্বি। রাব্বি নিউজবাংলাকে বলে, ‘ভালোই লাগে। আমদের জন্য এটা দরকার। যারা গরিব মানুষ এটা তাদের জন্য। রিকশা চালায় যারা তারা আসে অনেক সময় বড়লোক মানুষও আসে। খাবার দেয়াটা একটা উৎসব।’

নাতি ফাহিম নিয়ে ইফতার নিতে এসেছে কর্মজীবি নারী শাহানা বেগম। বালুর মাঠে মাছ কেটে চলে তার সংসার। তিনি নিউজিবাংলাকে বলেন, ‘রোজা রইছি এইহানে ইফতারিটা দেয় ভালো মতনই। আমরা আজীবন এইহান থেকে খাইয়া আইছি। ভালো জিনিসই দেয়।’

ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারের উদ্যোগে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবারাহ করা হয় জানিয়ে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানবতার আদর্শে উদ্বুদ্ব একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ মহাথের ২০১৩ সাল থেকে তিনি এই উদ্যোগ নেন। তার কাছে কোনো ধর্ম ছিল না। জাতি ছিল না। সবসময় মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। সবাইকে সেবা দিয়েছেন। মানুষ হিসেবে সবাইকে ভালোবাসি। ধর্ম তার নিজস্ব ব্যাপার। মানুষকে ভালোবাসতেই এই উদ্যোগ।’

এ সবকিছুই ভালোবাসার আদর্শের নিদর্শন বলে যোগ করেন তিনি।

হারুন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারীর ছেলে জহিরুল ইসলাম আহাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন ১৫০ প্যাকেটের আয়োজন করা হয়। ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি, আলুর চপ, মুড়ি থাকে। ২০১৪ সাল থেকে এদের সাথে যুক্ত হয়ে ইফতার দিই আমরা।’

ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারের এই ইফতার দেয়াকে ইতিবাচক ভাবেই দেখছেন এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘খাবারে তো নাম লেখা নাই কারও, বৌদ্ধরা দিতেছে না কে দিতেছে? এর মাধ্যমে অনেক দরিদ্র মানুষ ইফতার পাচ্ছে। আগে দেখতাম অনেক দূর থেকে মানুষজন আসছে। করোনার পর এখন কম মানুষের আয়োজন করা হয়। আগে আরও বেশি মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হতো।’

ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের আবাসিক ভিক্ষু দীপানন্দ ভিক্ষু নিউজবাংলাকে বলেন,‘ ২০১৩ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি শুদ্ধানন্দ মহাথের প্রথম এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরে তার শিষ্য সংগঠনের বর্তমান সভাপতি বুদ্ধপ্রিয় মহাথের এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ইফতার বিতরণ চালিয়ে যাচ্ছে।’

বৌদ্ধ ধর্ম মানবতার ধর্ম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়ার আলোকে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই বিহার বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠান হলেও হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান অনেকেই এখানে কাজ করেন।’

১৯৬০ সালে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার প্রতিষ্ঠা পায়। যেখানে প্রায় ২৮ জন আবাসিক বৌদ্ধ ভিক্ষু রয়েছে। এ ছাড়া ২৫০ জনের এতিম শিশুরা এখানে আবসিকভাবে থাকছে এবং শিক্ষাগ্রহণ করছে। এখানে কিন্ডারগার্টেন এবং ধর্মরাজিক উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। যেখানে এক হাজারের কাছাকাছি শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে।

ইফতার বিতরণের সময় বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি বুদ্ধপ্রিয় মহাথের, সহসভাপতি স্বরূপান্দ ভিক্ষুসহ সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এ বিভাগের আরো খবর