বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হৃদয় মণ্ডল পড়ান ভালো, প্রকৃতিতে জেদি

  •    
  • ৯ এপ্রিল, ২০২২ ১৯:৪৭

হৃদয় মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। তার বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষকতা জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা।

বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডল স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুরে। বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারের বাসায় শিক্ষার্থীদের যে কক্ষে পড়াতেন সেখানে একটি লেখা স্কচটেপ দিয়ে দেয়ালে সাঁটানো।

সাদা কাগজে কালো কালির অক্ষরে লেখা হয়েছে (বাক্য-বানান অপরিবর্তিত), ‘মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি, ধর্ম সৃষ্টি মানুষের। মহামানবেরা ধর্ম নিয়ে সৎ ও বাস্তব গল্প লিখে আর বিজ্ঞ ব্যক্তিরা তা বিশ্বাস করে বাস্তব কর্ম স্ব-চোক্ষে দেখে, ফলে উভয়ের কল্যাণ ও মঙ্গল এর মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে দূরত্ব কমে, ধরায় শান্তি আসে, সৃষ্টি রক্ষা পায়।

‘শয়তানেরা ধর্ম নিয়ে আজগুবি ও কাল্পনিক গল্প লিখে আর মূর্খেরা তার বাস্তব কর্ম না দেখে অন্ধ বিশ্বাসে জড়িয়ে পড়ে, ফলে স্রষ্টার সাথে দূরত্ব বাড়ে, শয়তানেরা ইহকালে লাভবান হয় আর মূর্খেরা ইহকাল-পরকাল উভয় জায়গায় ঠকে।

‘শয়তান নিজেই মানুষের সৎকর্মের স্বানিধ্যে আসে না, কারণ সৎকর্মের সংস্পর্শে শয়তানের মৃত্যু ঘটে।’

কথাগুলো অন্য কারো নয়, হৃদয় মণ্ডলেরই লেখা।

ওই লেখার শেষভাগে তিনি লিখেছেন, ‘ধর্ম, রাজনীতি ও বিবাহের আলাপ আমার রুমে সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ।’

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে আলোচনায় অনাগ্রহী এই বিজ্ঞানশিক্ষক ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দুই সপ্তাহ ধরে কারাগারে বন্দি। দিনে দিনে তার মুক্তির দাবি জোরাল হচ্ছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পালন হচ্ছে প্রতিবাদ কর্মসূচি। হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সরব।

স্ত্রী-সন্তানসহ শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল

তিনি জামিন পাচ্ছেন কিনা, জানা যাবে রোববার। এদিন মুন্সীগঞ্জের আদালতে তার জামিন শুনানির কথা রয়েছে।

হৃদয় মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। তার স্ত্রী ববিতা হাওলাদার রাজধানীর ওয়ারির একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে চাকরি করছেন। দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ হৃদয় বসবাস করছেন মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর এলাকায়।

হৃদয় মণ্ডলের বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষকতা জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। তার স্ত্রী ববিতা হাওলাদার বলেন, ‘আমার স্বামীকে সব সময় প্রতিবাদী ভূমিকায় পেয়েছি। তিনি সব কিছু যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করেন। বিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। কখনও শুনিনি তিনি কারও সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়েছেন।’

হৃদয় মণ্ডলের বাল্যবন্ধু তপন চন্দ্র সরকার একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুল থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত আমরা একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছি। হৃদয় মণ্ডল মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন ইউনিয়নের কালাগাইয়ের চর সরকারি বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শেষ করে। বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করেন কুচিয়ামোড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।

‘শ্রীনগর কলেজ থেকে বিজ্ঞানে এইচএসসি পাশ করে ১৯৮২ সালে। পরে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে।’

তপন চন্দ্র সরকার বলেন, ‘হৃদয় বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে ২১ বছর ধরে শিক্ষকতা করছে। এর আগে অন্য একটি স্কুলে পড়িয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সেটির নাম আমার মনে পড়েছে না।’

ব্যক্তি মানুষ হিসেবে হৃদয় মণ্ডল পরোপকারী জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো অন্যায় দেখলে আমার বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করত। এই অভ্যাসটা ছোট বেলা থেকে তার ছিল। গরিব-দুঃখীদের সব সময় সহযোগিতা করত।’

সহকর্মী হিসেবে হৃদয় মণ্ডলের প্রশংসা করেন বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক রানী সাহা। তিনি বলেন, ‘স্যার খুব ভালো মানুষ। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। অনিয়ম চোখে পড়লেই তাকে প্রতিবাদ করতে দেখেছি। তিনি খুব ভালো পড়ান। কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার আমার চোখে পড়েনি।’

সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সমমেহর বেগম সুমি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এই স্কুলে ১৯৯৬ সাল থেকে পড়াই। তবে আমি স্যারকে আরও আগে থেকে চিনি। তিনি ভালো মানুষ। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারে। কারও সঙ্গে ঝগড়া হলেও তা বেশি দিনে মনের মধ্যে রাখতেন না।’

আরেক শিক্ষক তরুণ চন্দ্র বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আগে কখনও ওঠেনি। তিনি একটু জেদি প্রকৃতির। তবে মানুষ হিসেবে খারাপ না।’

হৃদয় মণ্ডলের সাবেক ছাত্র জয় ঘোষ বলেন, ‘স্যার আগে মেয়েদের সেকশনে পড়াতেন। কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের পড়াচ্ছেন। আমরা কখনও স্যারের খারাপ আচরণ দেখিনি। তবে অন্যায়-অনিয়ম হলে তাকে প্রতিবাদ করতে দেখেছি।’

আরেক ছাত্র রাহুল বর্মন, ‘স্যার ক্লাসে খুব ভালো পড়ান। তিনি আমাদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি।’

দশম শ্রেণির ছাত্র মো. আকাশ নিউজবাংলাকে বলে, ‘স্যার পড়ান ভালো। তবে সব সময় জোরে কথা বলতেন। এতে তাকে সবাই একটু ভয় পায়।’

নবম শ্রেণির ছাত্র হৃদয় বলেন, ‘স্যার খুব মিশুক ছিলেন না। তার গাম্ভীর্য আমাদের ভীত করত। তবে তিনি খুব ভালো পড়ান।’

প্রতিবেশী সীমা আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হৃদয় স্যার খুব একটা বাসা থেকে বের হতেন না। স্কুলের পাশে আমাদের বাসা হওয়ায় ছাত্ররা এই রাস্তা দিয়ে যেতে বলাবলি করত শুনতাম যে স্যার খুব জেদি ছিলেন। ছাত্ররা খুব ভয়ে থাকতো।’

গত ২০ মার্চ দশম শ্রেণির ক্লাসে হৃদয় মণ্ডল ধর্মকে একটি ‘বিশ্বাস’ এবং বিজ্ঞানকে ‘প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। গোপনে তার অডিও ধারণ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয় এক শিক্ষার্থী।

ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদের কাছে ওই শিক্ষকের নামে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দেয়। প্রধান শিক্ষক কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিন দিনের মধ্যে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে জবাব দিতে বলেন। তবে এর আগেই ২২ মার্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা জোটবদ্ধ হয়ে হৃদয় মণ্ডলের শাস্তির দাবিতে স্কুলে মিছিল বের করে।

বিদ্যালয় চত্বরের পাশের রিকাবীবাজার এলাকাতেও মিছিল হয়। এই মিছিলে বহিরাগতরা উসকানি দেয় বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

প্রধান শিক্ষক পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খবর দেন। স্কুলে গিয়ে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে ভেস্তে যায় সেই আলোচনা। একপর্যায়ে হৃদয় মণ্ডলকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। রাতে তার নামে মামলা করেন স্কুল সহকারী মো. আসাদ।

আসাদ শুরুতে জানান তিনি প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে মামলা করেছেন। তবে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ দাবি করেন তিনি আসাদকে মামলা করতে বলেননি। তাকে পুলিশ মামলা করতে বলতে পারে। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজ উল ইসলাম (সদর সার্কেল) জানান, প্রশাসন থেকে মামলার জন্য কাউকে জোর করা হয়নি।

এ বিভাগের আরো খবর