বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল সব বিজ্ঞানশিক্ষকের কণ্ঠস্বর উল্লেখ করে যে বই পড়ানোর জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বই লেখার জন্য নিজের গ্রেপ্তার চেয়েছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে শনিবার বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে বক্তব্যে তিনি এমন কথা বলেন।
নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম এই সমাবেশ আয়োজন করে।
গত ২০ মার্চ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেন হৃদয় মণ্ডল। সেটি গোপনে রেকর্ড করে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
এরপর ২২ মার্চ স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মিছিল করে। পরে পুলিশ হৃদয় মণ্ডলকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। সে রাতেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত ও বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ওই বিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী মামলা করেন। পরে হৃদয় মণ্ডলকে সে মামলায় জেল-হাজতে পাঠায় আদালত।
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদ করতে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ঘটনার প্রতিবাদ করে হৃদয় মণ্ডলের মুক্তি দাবি করেন।
বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে শাহবাগে শনিবারের সমাবেশে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি আজ এখানে দাঁড়িয়েছি মনে অনেক দুঃখ এবং কষ্ট নিয়ে। হতাশাও বলতে পারতাম, কিন্তু যেহেতু প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনে হতাশ হব না, সে কারণে হতাশ কথাটা ব্যবহার করলাম না। তবে আমি ক্ষুব্ধ; অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কারণ কী আপনারা সবাই জানেন।
‘আমরা সব সময় শুনে আসছি, আমাদের দেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটার প্রথম ধাপ হচ্ছে, আমরা যেন স্কুল-কলেজে আমাদের সন্তানকে সঠিকভাবে বিজ্ঞান শেখাতে পারি। ঠিক সেই দায়িত্বটি পালন করতে গিয়েছিলেন হৃদয় মণ্ডল। শুধু এ কারণে তাকে হাজতে থাকতে হচ্ছে। এটি আমাদের দেশ, আমার বিশ্বাস হতে চায় না। এটি কীভাবে সম্ভব?’
এই সাহিত্যিক বলেন, ‘একজন মানুষ, একজন শিক্ষক তার দায়িত্ব পালন করেছেন। বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন এবং সেখানে কোনো একজন ছাত্র কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন এবং তিনি সেখানে সে প্রশ্নের সবচেয়ে যৌক্তিক উত্তরটি দিচ্ছেন। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তার করে হাজতে রাখা হয়েছে। এটা বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।
‘আমার দুঃখটা কোথায়? যে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে তিনি নিগৃহীত হচ্ছেন বা হয়েছেন, সেই বিজ্ঞান বইগুলো আমরা মিলে লিখেছিলাম। এখানে সৌমিত্র আছে, সে বায়োলজি বই লিখেছিল, আমি পদার্থবিজ্ঞানের বই লিখেছিলাম এবং আমরা সবাই মিলে বইগুলো সম্পাদনা করেছিলাম। সেই বই পড়াতে গিয়ে তার কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।’
বক্তব্যে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি বলেছি অলরেডি, যে কথাগুলো উচ্চারণ করার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যে কারণে হাজতে রাখা হয়েছে, যে কারণে জামিন দেয়া হচ্ছে না, হুবহু এই কথাগুলো শুধু আমি না, পৃথিবীর সব বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এ কথাগুলো বলে থাকে এবং উচ্চারণ করে থাকে।
‘তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব, আমরা বাইরে ঘোরাফেরা করছি আর তিনি জেলখানায় আছেন। আমরা কেন জেলে নাই, আমাদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না?’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘যা-ই হোক, দেরিতে হলেও আমরা দেখছি, দেরিতে হলেও আমাদের দেশের মানুষ বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিবাদ করছেন।’
এ ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, বিষয়টি ঘটেছিল মার্চ মাসের ২২ তারিখে। কিন্তু তখন তারা এটি নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করেনি। তখন ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করার সময়। তারা বুঝেছিল এ সময় সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে কথা বলে তেমন লাভ হবে না। কখন শুরু করেছে? যখন রমজান শুরু হয়েছে তখন। তখন চেতনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। সেই ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের পুলিশ বাহিনী হৃদয় মণ্ডলকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।’
‘আমরা এখানে আজ সবাই মিলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে চাই। আমরা বলতে চাই, এ দেশটা আমাদের, এ দেশটাকে আমরা ভালোবাসি। এ দেশটাকে আমরা জ্ঞানভিত্তিক দেশে পরিণত করতে চাই,’ বলেন তিনি।
জাফর ইকবাল বলেন, ‘এ জন্যই হৃদয় মণ্ডলের মতো যে শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, তাদের আমরা অভিনন্দন জানাতে চাই। এ ঘটনা যেন বাংলাদেশে আর না ঘটে আমরা সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই। আমাদের প্রিয় দেশ, এই দেশটি আমাদের। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে যখন হেফাজত দাবি করেছিল টেক্সট বই থেকে অনেক লেখা সরিয়ে দিতে হবে, সেই টেক্সটগুলো ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আমরা তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। আমাদের কথাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
‘কিন্তু একসময় তারা দেখতে পারল এই হেফাজত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে নদীতে ফেলে দেয়ার কথা উচ্চারণ করেছে। সরকারের তখন বোধোদয় হয়েছে। এখানেও সেই একই ব্যাপার। আমরা একই কথা বলতে চাই, আমরা মাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছি। আপনারা সবাই জানেন, বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অসাম্প্রদায়িক লোক কেউ ছিলেন না। তিনি সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তার দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম কথাটি সরিয়ে আওয়ামী লীগ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সব মানুষ যেন দলটি বহন করে। সেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর পর এখন আমরা যদি এ দেশে এমন একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা দেখতে পাই, সেটা আমাদের পক্ষে মেনে নেয়া খুব কষ্টকর।’
তিনি বলেন, ‘আমি আমার সাংবাদিক ভাইদের অনুরোধ করব, আপনারা আপনাদের দায়িত্বটুকু পালন করেন। কারণ ঘটনাটা ঘটার পরও আমি অনেক দিন পরে এর খবর পেয়েছি।
‘আমি কেন এতদিন পর খবরটি পেয়েছি তা জানি না। কেন সংবাদমাধ্যমে, টেলিভিশনে খবরটি আসেনি, সেটা আপনাদের কাছে জানতে চাই। অনুগ্রহ করে সত্য ঘটনাটি তুলে ধরুন। বাংলাদেশি আপনাদের এবং আমাদের হৃদয় মণ্ডল এবং তার মতো শিক্ষকদের। আমরা সবাই মিলে আমাদের দেশটাকে গড়ে তুলব- এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
সমাবেশে মানবধিকারকর্মী খুশি কবীর বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মীয় রাষ্ট্র থেকে নিজেকে আলাদা করে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন যা ঘটছে বা ঘটতে দেয়া হচ্ছে, এটির জন্য যদি আমরা স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ না করি বা রুখে না দাঁড়াই, তাহলে আমরা আবার পিছিয়ে যাব।’
তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষককে ছাত্ররা অনেক প্রশ্ন করতে পারে বা বুঝার জন্য অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে। এটি তাদের অধিকার আছে। কিন্তু বিজ্ঞান বিজ্ঞানই৷ বিজ্ঞানের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে পড়াশোনা এবং বিষয়গুলো বুঝানোর বিষয়ে যদি আপত্তি থাকে... সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার হলো, যে শিক্ষক, ছাত্র বা ছাত্রের অভিভাবকও না, সে তার ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত এনেছে দাবি করে মামলা ঠুকে দিয়েছে। আর সাথে সাথে শিক্ষককে গ্রেপ্তার এবং এই মামলায় জামিন না মঞ্জুর করা হচ্ছে। এটি কোন ধরনের কথা? এটি কোন ধরণের রাষ্ট্রে আমরা বাস করছি?’
গৌরব একাত্তরের সভাপতি এসএম শাহিন বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি মস্তিষ্কের যারা সাম্প্রদায়িক শক্তি তারা আজ নতুনভাবে নতুন মোড়কে আমাদের ঘিরে রাখার চেষ্টা করছে। আর আমরা গুটিকয়েক মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তারা চিৎকার করছি। এখন শুধু কি আমরা চিৎকার করব নাকি প্রতিরোধের ডাক দেব?’
বক্তব্য শেষে কর্মসূচি ঘোষণা করেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ প্লাটফর্মের অন্যতম সংগঠক আকরামুল হক।
তিনি বলেন, ‘আগামীকাল হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের জামিন শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এই শুনানিতে যদি শিক্ষকের মুক্তি না হয় তাহলে আমরা আগামী ১৩ এপ্রিল বুধবার ফের শাহবাগে সমাবেশ করব।’
যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মাসুমের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি বরিন্দ্র কুমার নাথ, অগ্নি ফাউন্ডেশনের নেত্রী ক্রিস্টিয়ানা, মাইনরোটি রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত মজুমদার, শিক্ষাবিদ ড. রতন সিদ্দিকি, জনরাষ্ট্র আন্দোলনের সদস্য সচিব কামরুল হোসেন, অ্যাডভোকেট বিকাশ চন্দ্র জয় প্রমুখ।