উজানের ঢলে প্লাবিত হয়েছে হাওর, তলিয়ে গেছে কষ্টের ফসল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না কৃষকদের। কেউ কেউ কাঁচা ধানই কেটে নিয়ে গেছেন বাড়িতে।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের আফাইন্নের হাওর, নালুয়া আর চাচুয়ার হাওর এলাকায় বছরে একবারই ধান হয়। এই ধানের ওপর নির্ভর করে এই এলাকার কৃষকদের সারা বছরের যাবতীয় খরচ। আর কিছুদিন পর শুরু হতো ধান কাটা। তার আগেই ফসল হারিয়ে পথে বসতে হয়েছে কৃষকদের।
অনেকেই অনাহারে-অর্ধাহারে বছর পার করার আশঙ্কা করছেন। কেউ কেউ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ঋণের টাকা শোধ করা নিয়ে। আবার কেউ ভাবছেন খড়ের অভাবে বিক্রি করে দেবেন গবাদিপশু।
ধনপুর ইউনিয়নের দীনেশপুর গ্রামের শনি লাল দাসের স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের সংসার। রোজগারের একমাত্র অবলম্বন কৃষিজমি। জমির ফসল থেকে নিজেদের বাৎসরিক খোরাক রেখে বাকিটা বিক্রি করে সংসার চালান।
শনি জানান, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এবার নালুয়া হাওরে পাঁচ একর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। উজানের ঢলে সব হারিয়ে এখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। কীভাবে মহাজনের ঋণ শোধ করবেন আর কীভাবে সংসার চালাবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ‘আশা ছিল বৈশাখে ঋণ শোধ করব। এখন ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, নিজে কীভাবে চলব এই চিন্তায় ঘুম আসছে না।’
চাচুয়া গ্রামের ভূপেন্দ্রচন্দ্র দাসের নিজের কোনো জমি নেই। তার সম্বল শুধু পাঁচটি গরু আর বসতভিটা। চাচুয়া হাওরে এবার অন্যের পাঁচ একর জমি চাষ করেছিলেন।
ভূপেন্দ্র বলেন, ‘চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অন্যের জমি চাষ কইরা খুব একটা লাভবান হওয়া যায় না। সারা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে নিজেদের খোরাকের চাল আর গরুর খড় পাওয়া যায়। এবার সব তলাইয়া গেছে। এখন নিজেরা কী খাইমু আর গরু-বাছুররেই কী খাওয়ামু? গরু-বাছুর বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।’
ভূপেন্দ্রের প্রতিবেশী সুভাসী রাণী দাস বলেন, ‘অন্যান্য বছর এই সময় সবাই ধানের গোলা আর খলা বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। এবার খলা তৈরির আগেই সব শেষ।’
হাওর দেখিয়ে সুভাসী বলেন, ‘দেখেন, গত বছর এই জায়গা ছিল সম্পূর্ণ শুকনা। আর এবার এই জায়গাটায় নৌকা চলছে। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে ভাই। ঘরে নিজেদের খোরাক নাই, গরু-বাছুরেরও খাবার নাই। সব পানির নিচে। এখন গরু-বাছুর বিক্রি করে খাওয়া ছাড়া উপায় নাই।’
গরু ব্যাপারিরা কৃষকদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন অভিযোগ করে বলেন, ‘পানির নিচে সব তলিয়ে গেছে দেখে গরু ব্যাপারিরা দাম কম বলছে। গতকালও কয়েকজন পাইকার এসেছিল। যে গরুর দাম হওয়ার কথা ৫০ হাজার টাকা, তারা সেটার দাম ৩০ হাজারের ওপরে বলেই না।
‘এমন একটা বিপদে আছি যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখন সরকার যদি সহযোগিতার হাত না বাড়ায় আমরা বাঁচব না। না খেয়ে মরতে হবে।’
ধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ‘আমার পুরো ইউনিয়নে কৃষকদের আহাজারি চলছে। অনেকের ঘরে চুলা জ্বলে না। এমন অনেক পরিবার আছে যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে এ ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।’
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক শামীম আলম।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতির ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, ‘এর আগেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওরের কৃষকদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। এবারও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে কীভাবে সহায়তা করা যায়, সেটা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কৃষকদের ধৈর্যের সঙ্গে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।’