রাজধানীর মালিবাগের কল্যাণী ইনক্লুসিভ প্রাইমারি স্কুলের এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে পাশ্ববর্তী সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন কর্মী মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করছে।
তাওসিফ আহনাফ নামের ওই শিশুটির বাবা আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সুরুজ মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী জানার পরেও মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার ছেলের বিরুদ্ধে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ তুলেছে। একটি অটিস্টিক শিশুর পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের সচিব মহিন উদ্দিন তার রুমে নিয়ে মারধর করেন তাওসিফকে।’
২৯ মার্চে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার বিষয় জানতে চাইলে সুরুজ নিউজবাংলাকে বলেন, “আমার বাচ্চার বয়স ১৫ বছর, তবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় তার আচরণ ছয় বছরের শিশুর মতো। রাজধানীর মালিবাগের কল্যাণী ইনক্লুসিভ প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে সে। প্রতিদিনের মতো ২৯ মার্চ স্কুলে গিয়েছিল। তবে গেটের সামনে থেকে তাওসিফ ‘স্কুলে যাব না, তোমার সঙ্গে অফিসে যাব’ বলে বায়না ধরে। কিন্তু আমার অফিসে জরুরি মিটিং থাকায় তাকে সঙ্গে নিতে চাইনি। ওকে স্কুলের গেটে নামিয়ে আমি একটু এগিয়ে যাই। তখন ও পেছন থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অফিসে যেতে চায়।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী তাওসিফ আহনাফের স্কুলের পাশ্ববর্তী সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ। ছবি: নিউজবাংলা
“ওর স্কুলের ঠিক পাশেই সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ। এ সময় কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে তিনটি মেয়ে আমাদের দেখছিল এবং তারা হাসাহাসি করছিল। এগুলো দেখে আমার ছেলে ঐ মেয়েদের গিয়ে বলে, ‘তাকাবা না।’ প্রতিটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। তাওসিফের দিকে কেউ তাকালে সে বলে ‘তাকাবা না।’ তখন জবাবে কেউ যদি বলে, ‘ঠিক আছে তাকাব না’, তাহলে সে শান্ত হয়ে যায়। তবে আমি যখন ছেলেকে বোঝাচ্ছি, তখন মেয়েগুলো হাসছিল। এরপর তাওসিফ তাদের দিকে এগিয়ে গেলে মেয়েগুলো চিৎকার করে দৌড়ে কলেজের মধ্যে চলে যায়, তাওসিফও তাদের পেছনে যায়।
মালিবাগের কল্যাণী ইনক্লুসিভ প্রাইমারি স্কুলের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে পাশ্ববর্তী সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন কর্মী মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ছবি: নিউজবাংলা
“এ সময় সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের সচিব মহিন উদ্দিন তাওসিফকে মারধর শুরু করেন। দ্রুত আমি সেখানে গিয়ে তাকে অটিস্টিক শিশু বলে থামানোর চেষ্টা করি। তার পরও তিনি আমার ছেলের দুই গালে আরও দুটি থাপ্পড় দেন, যা দেখা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টের। আমি প্রতিবাদ করলে সিকিউরিটি গার্ডরা আমাকেও মারতে উদ্যত হয়। খবর পেয়ে তাওসিফের স্কুল থেকে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা এসে প্রতিবাদ করেন, যা পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।”
তাওসিফের বাবা আরও বলেন, ‘এই ঘটনায় তাওসিফ আহনাফ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওকে ওই হাসপাতাল থেকে বের করে ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর বাসায় নিয়ে আসি। এখনও তার বুকে চাপ ধরে আছে।’
রমনা থানা মামলা নিতে রাজি নয়
তাওসিফের বাবা সুরুজ মিয়া জানান, এ ঘটনায় রমনা থানায় মামলা করতে গেলে ওই থানার এসআই তোফাজ্জেল হোসেন মামলা নিতে অস্বীকার জানান। তিনি সুরুজ মিয়াকে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলেন।
৩১ মার্চ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়রি করা হয়, তবে এখনও কোনো ধরনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি পুলিশ। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার বিকেলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়নি। সুরুজ মিয়া আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ নিয়ে সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের সচিব মহিন উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে এমন কোনো ঘটনা ঘটে নাই। ছেলেটা যখন মেয়েটার সামনে চলে এসেছে, তখন আমি তাকে দুই হাত ধরে বাইরে বের করে নিয়ে আসছি। কারণ মেয়েটা অনেক ভয় পেয়েছে এমন অদ্ভুত আচরণে।’
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. ফারুকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর বাবা চাইলে তাওসিফকে আটকাতে পারতেন। তার সন্তান এমন আচরণ করে, সেটা তার জানা ছিল। মেয়ে শিক্ষার্থী ভয়ে এক কর্মচারীর রুমে আশ্রয় নেন। সেখানেও ছেলেটা ঢুকে পড়ে। ছেলেটাকে দুই হাত ধরে সেখান থেকে বাইরে নেয়া হয়। তখন তার বাবা ক্ষেপে গিয়ে হাসপাতালের কর্মচারীর ওপরে চড়াও হন। আমরা প্রতিবন্ধী ছেলেটার বিষয়ে যতটা গুরুত্ব দিয়েছি, ততটাই শিক্ষার্থী মেয়েটার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। ঘটনার পর অভিভাবকদের ডেকে সমাধানের চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা রাজি হননি।’
কী ঘটেছিল জানতে নিউজবাংলার প্রতিবেদক হাসপাতালটির সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। এই ফুটেজে দেখা যায়, তাওসিফকে নিয়ে তার বাবা সুরুজ মিয়া ওই স্কুলের পাশে হাসপাতালটির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় তিন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ান। ওই তিনজনের একজন ওড়না ঠিক করছিলেন। মেয়েটিকে দেখে তাওসিফ এগিয়ে আসতে থাকে। তার এগিয়ে আসা দেখে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীও দৌড় দেন। তখন তাওসিফও পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে। তাদের পেছনে সুরুজ মিয়াও দৌড়ে আসেন। মেডিক্যাল শিক্ষার্থী মেয়েটি দৌড়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি কক্ষে প্রবেশ করেন।
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন অনেকে। তারা বলেছেন, একটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর সঙ্গে এ ধরনের আচরণ সত্যিই দুঃখজনক। এর জন্য অপরাধীদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা থানায় এ অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তোফাজ্জল হোসেন নিউজবাংলা বলেন, ‘আমরা মেডিক্যাল কলেজের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। এটি আদালতে পাঠানো হয়েছে অনুমতির জন্য। দুই-এক দিনের মধ্যে অনুমতি হয়তো চলে আসবে। তারপরে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’