আমদানির জোয়ার, পাশাপাশি বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে বাণিজ্য ঘাটতি চূড়ায় উঠেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩০ কোটি ৬০ লাখ (২২.৩০ বিলিয়ন) ডলার। বর্তমান বিনিময়হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) প্রায় সমান। আর জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই আট মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২৮০ কোটি লাখ (২.৮০ বিলিয়ন) ডলার।
এর আগে আট মাসে এত বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে কখনই পড়েনি বাংলাদেশ। আর এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ১২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন (১ হাজার ২৮৩ কোটি)। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে এই মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর ও মঞ্জুর হোসেন।
তারা বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমদানির লাগাম টেনে ধরা। যে করেই হোক এটা করতে হবে। তা না হলে সংকটে পড়বে অর্থনীতি।’
করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই আমদানিতে জোয়ার বইছে। আর এতে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান বা বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৪ হাজার ৩৪৭ কোটি ৭০ লাখ (৫৪.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই আট মাসে ৩ হাজার ৭০৬ কোটি ৭০ লাখ (৩৭.০৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩ হাজার ২০৭ কোটি ১০ লাখ (৩২.০৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।
এ হিসাবেই অর্থবছরের আট মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
সেবা বাণিজ্যে ঘাটতিও বাড়ছে
জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫০ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার
২০২১-২২ অর্থবছর শুরুই হয়েছিল লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে। দিন যত যাচ্ছে, ঘাটতি ততই বাড়ছে। প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩১ কোটি ৪০ লাখ (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার। চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।
ডিসেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সবশেষ জানুয়ারি শেষে ১০ দশমিক শূন্য ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
ফেব্রুয়ারি শেষে তা ১২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। এর আগে কোনো অর্থবছরেও এত ঘাটতিতে পড়েনি বাংলাদেশ।
করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমায় ৯২৭ কোটি ৪০ লাখ (৯.২৭ বিলিয়ন) ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
তবে আর্থিক হিসাবে এখনও বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৩ কোটি ১০ লাখ (১০.৯৩ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরের এই সময়ে ৬৪৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে জানান আহসান মনসুর।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের আট মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৫৯০ কোটি (৫.৯ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই আট মাসে ৩৭৩ কোটি ৬২ লাখ ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তবে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সামগ্রিক লেনেদেনে (ওভারঅল ব্যালান্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২২ কোটি ২০ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৬৮৭ কোটি ৯০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
রেমিট্যান্স কমেছে ১৯.৪৬ শতাংশ
জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ হাজার ৩৪৪ কোটি (১৩.৪৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ কম।
২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ১৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
যে কারণে বেড়েছে আমদানি ব্যয়
আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াও বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
গত বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৬০ ডলার। বৃহস্পতিবার সেই তেল ১০০ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় এর দর ১৩৯ ডলারে উঠে গিয়েছিল।
গত আট মাসে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। শিল্পে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৩২ শতাংশ।
মহামারির পর চাহিদা বাড়ায় খাদ্যপণ্য (বিশেষ করে গম), ভোজ্যতেল, শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ সব ধরনের জিনিসের দামই বেড়েছে।
গত বছরের মার্চে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৫০ থেকে ৯০০ ডলার। বর্তমানে এই তেল ১ হাজার ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। মাঝে দর ১ হাজার ৮০০ ডলারে উঠেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট আমদানি ব্যয়ের ৭০ শতাংশের মতো খরচ হয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও অন্য পণ্য আমদানিতে। একই সঙ্গে এ খাতে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিও বেড়েছে।
তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। গত বছরের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩০ কাউন্ট মানের সুতার দাম ছিল ৩ ডলারের মতো। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ৪ দশমিক ২০ থেকে ৪ দশমিক ৩০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। এখন তা ৪ দশমিক ১০ থেকে ৪ দশমিক ১৫ ডলারে নেমেছে।
‘যে করেই হোক আমদানি কমাতে হবে’
অস্বাভাবিক আমদানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়। আমাদের কোমরের বেল্টটা এখন টাইট করতে হবে। যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এ ছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। বলা হয়, আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘দাম বাড়ায় সরকারের জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, গ্যাসে বেড়েছে, সারে বেড়েছে, বিদ্যুতেও বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার ভর্তুকি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ পড়বে।’
এ ক্ষেত্রে এখন করণীয় কী- এ প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘সরকারকে সাশ্রয়ী হতে হবে। একই সঙ্গে দেশের মানুষকেও সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কম খরচ করতে হবে। আমাদের অনেক কিছুই কিন্তু জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার, পানি- এসব কিছু উৎপাদনে তেলের প্রয়োজন হয়। এই সংকটের সময়ে এসব কিছু যেন মানুষ কম ব্যবহার করে।
‘পরিবহন খাতে যদি জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো যায়, তাহলে আমদানি খাতে খরচ কমবে। সরকারের ভর্তুকি কমবে। অন্যদিকে বিলাসবহুল পণ্য যাতে কম আমদানি হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজন নেই এমন পণ্য আমদানি থেকে এখন বিরত থাকতে হবে।’
একই কথা বলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক মঞ্জুর হোসেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যে পণ্যের খুব বেশি প্রয়োজন নেই, এলসি মার্জিন বাড়িয়ে এবং অন্য সব উদ্যোগ নিয়ে সেগুলোর আমদানি বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।’