ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বহিরাগতরা উসকানি দিয়েছে বলে দাবি করছেন এলাকাবাসী। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশও বলছে একই কথা। তবে বহিরাগতদের কাউকে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বহিরাগতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ঘটনার পর হৃদয় মণ্ডলের বাড়িতেও হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী। তিনি বলছেন, তারা নানান হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
মুন্সীগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০ মার্চ দশম শ্রেণির ক্লাসে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করেন হৃদয় মণ্ডল। তিনি ধর্মকে একটি ‘বিশ্বাস’ এবং বিজ্ঞানকে ‘প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। গোপনে তার অডিও ধারণ করে এক শিক্ষার্থী।
ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদের কাছে ওই শিক্ষকের নামে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দেয়। প্রধান শিক্ষক কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিন দিনের মধ্যে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে জবাব দিতে বলেন। তবে এর আগেই ২২ মার্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা জোটবদ্ধ হয়ে হৃদয় মণ্ডলের শাস্তির দাবিতে স্কুলে মিছিল বের করে।
বিদ্যালয় চত্বরের পাশের রিকাবীবাজার এলাকাতেও মিছিল হয়। প্রধান শিক্ষক পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খবর দেন। স্কুলে গিয়ে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে ভেস্তে যায় সেই আলোচনা। একপর্যায়ে হৃদয় মণ্ডলকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
আরও পড়ুন: বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বক্তব্য গোপনে যেভাবে ধারণ
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মীরকাদিম পৌর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মোহাম্মদ শরিফুজ্জামান শরীফ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ওখানে গিয়েছিলাম এবং বসে কথা হয়েছিল। তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সদুত্তর না দিতে পারলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়েছিলাম। তবে আমাদের কথা তারা (শিক্ষার্থী) শোনেনি। পরে দেখলাম এখানে ইন্ধন রয়েছে বহিরাগতদের।’
একই কথা বলেন মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান আনিস। তিনি বলেন, ‘ওরা কোনো কিছু মানছিল না। অবশ্যই চারদিকে বহিরাগতরা ছিল। আমরা তো এলাকায় স্থানীয় না, স্থানীয়রা বলতে পারবে তারা কারা।’
মুন্সীগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজ উল ইসলাম বলেন, ‘ওই দিন শিক্ষার্থীর ইউনিফর্ম ছাড়াও বেশ কিছু লোককে বিদ্যালয়ে দেখেছি। তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণে উগ্রতা ছিল।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্কুলের সামনের গেটের দিকে অনেক আওয়াজ হচ্ছিল, বহিরাগতরা অবশ্যই ছিল। তবে আমি যেহেতু নিজে দেখিনি তাই বলতে পারব না তারা উসকানি দিয়েছিল কি না।’ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মামলায় প্রায় দুই সপ্তাহ কারাগারে আছেন হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। তিনি রামকুমার বিদ্যালয়ের পাশে স্কুল কোয়ার্টারে স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে ও মাকে নিয়ে থাকতেন। গ্রেপ্তারের পর তার বাসায় এসেছেন শ্যালক বাদল হাওলাদার।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ভাগনে (হৃদয়ের ছেলে) তার বাবার স্কুলেই পড়ে। ঘটনার পর থেকে স্কুলে গেলেই তাকে বাজে কথা শুনতে হচ্ছে। ছাত্রদের কেউ কেউ বলছে, আসামির ছেলে। সে যাতে ভালোভাবে স্কুলে যেতে পারে সেই পরিবেশ আমি চাই।’
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর স্কুলে হওয়া এই বৈঠক ভেস্তে যায়। ছবি: নিউজবাংলা
হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদার বলেন, ‘ঘটনার পর বাড়ির জানালা-গেটে লাথি পড়ছে। বাসা থেকে বের হলে গালাগাল করা হচ্ছে। আমার মা ডায়াবেটিসের রোগী। তিনি হাঁটতে বের হলে কটূক্তি করা হচ্ছে। আমি আমার ছেলেকে বলেছি, তোর বাবা তো কাউকে খুন করেনি, চুরি করেনি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
কারা কটূক্তি করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আগে ঢাকায় থাকতাম। বেশি দিন হয়নি এখানে এসেছি। যারা কটূক্তি করছে আমি তাদের চিনি না। স্থানীয়রা তাদের চিনতে পারে।’
যা বলছে পুলিশ
বাড়িতে হামলা ও গালাগালের বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আরও পড়ুন: বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় ঠিক করেননি: ঢাবি শিক্ষক নেতা
বিজ্ঞানশিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মামলাটি তদন্ত করছেন সদর থানার উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওই দিন বিদ্যালয়ের আশপাশে বহিরাগতরা ছিল। আমরা তাদের আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।’
শিক্ষক নেতাদের দাবি
হৃদয় মণ্ডলকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবিতে বিবৃতি দিয়েছে মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি। সংগঠনটি বলছে, ‘বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়াই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা দুঃখজনক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
কুচক্রীমহলের উসকানিতে ওই শিক্ষককে হেনস্তা করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির নেতারা।
সমিতির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মো. মতিউর রহমান মোল্লা ও সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। একজন সিনিয়র শিক্ষককে বিচারবহির্ভূতভাবে হেনস্তা করা শিক্ষকসমাজ মেনে নেবে না। কথায় কথায় শিক্ষকদের যেকোনো অজুহাতে পুলিশি হয়রানি করা সভ্যতার পরিচায়ক নয়।’
যারা এ ঘটনা নিয়ে ‘ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে’ এবং ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট’ করতে চাচ্ছে, তাদেরও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি।
অভিযোগের সর্বোচ্চ সাজা ২ বছরের জেল
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় মামলা করা হয়েছে। এই ধারায় ‘কোনো শ্রেণিবিশেষের ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে আবমাননা করে ওই শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষাত্মক কাজের’ সংজ্ঞা ও শাস্তির প্রসঙ্গ রয়েছে।
এই ধারায় বলা হয়, ‘যে ব্যক্তি, বাংলাদেশের নাগরিকদের যে কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর অপমানিত করার অভিপ্রায়ে ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষাত্মকভাবে উচ্চারিত বা লিখিত শব্দাবলির সাহায্যে বা দৃশ্যমান কোনো বস্তুর সাহায্যে ওই শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করে বা অবমাননা করার চেষ্টা করে, সে ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’