বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় ঠিক করেননি: ঢাবি শিক্ষক নেতা

  •    
  • ৭ এপ্রিল, ২০২২ ১৬:০২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ৯০ শতাংশ মানুষ যেহেতু মুসলিম, সেখানে ধর্ম নিয়ে কন্ট্রাডিকটরি বক্তব্যটা দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয় বলে আমি মনে করি।’

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কারাগারে যাওয়া মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত ও বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই বিজ্ঞানশিক্ষককে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী ও সমাজবিদরা।

সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির আগ্রাসনকে সমাজের জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলেও মনে করছেন অনেকে। তবে তুমুল সমালোচনার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনে করছেন, ধর্ম নিয়ে কথা বলা হৃদয় মণ্ডলের ঠিক হয়নি। আর সমিতির সভাপতি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে শুক্রবার বিকেলে শাহবাগে সমাবেশ করবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। পরদিন শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় শাহবাগে আরও একটি প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’।

শনিবারের কর্মসূচিতে বিজ্ঞানভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন আয়োজক রবিন আহসান।

লেখক, প্রকাশক ও সংস্কৃতিকর্মী রবিন আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনা মেনে নেয়া খুব কঠিন। পড়ানোর দায়ে একজন বিজ্ঞানশিক্ষককে কারাগারে থাকতে হচ্ছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি আগামী রোববার তার জামিন শুনানির জন্য যে দিন ধার্য করা হয়েছে, সেদিন যেন তাকে জামিন দেয়া হয়। সেই সঙ্গে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে।’

রবিন আহসান মনে করেন, পরিকল্পনা করে ওই শিক্ষকে ফাঁসানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘যারা সুপরিকল্পিতভাবে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।’

হৃদয় মণ্ডলকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবিতে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি। সংগঠনটি বলছে, ‘বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়াই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা দুঃখজনক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

কুচক্রীমহলের উসকানিতে ওই শিক্ষককে হেনস্তা করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির নেতারা।

সমিতির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মো. মতিউর রহমান মোল্লা ও সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। একজন সিনিয়র শিক্ষককে বিচারবহির্ভূতভাবে হেনস্তা করা শিক্ষক সমাজ মেনে নেবে না। কথায় কথায় শিক্ষকদের যেকোনো অজুহাতে পুলিশি হয়রানি করা সভ্যতার পরিচায়ক নয়।’

যারা এ ঘটনা নিয়ে ‘ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে’ এবং ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট’ করতে চাচ্ছে, তাদেরও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি।

মানবাধিকার সংগঠন আমরাই পারি-এর প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হকও এই ঘটনাকে পরিকল্পিত হিসেবে দেখছেন।

এই অধিকারকর্মী বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এগুলো কানেক্টেড। টিপের বিরুদ্ধে কথা হচ্ছে, নারীরা হাতমোজা, পা-মোজা পরে প্রেস কনফারেন্স করছে, টিএসসিতে নামাজের জায়গা চাওয়া হচ্ছে, একজন হিন্দু টিচারকে বিজ্ঞান এবং ধর্ম নিয়ে যে ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছে, তা ক্লাস টেনের একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে করার কথা না।’

দীর্ঘদিন ধরে মানুষের আচরণ এবং সমাজ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে জিনাত আরা হক বলেন, ‘যে দলগুলো ধর্মকে বেজ করে মানুষকে মোটিভেট করতে চায়, এরা সংঘবদ্ধভাবে কাজগুলো করছে। তারা এ রকম ছোট ছোট অ্যাকশনগুলো নিচ্ছে।’

সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই অধিকারকর্মী। তিনি বলেন, ‘এগুলোকে প্রতিরোধ করার কোনো পরিকল্পনাও নেই, কোনো ভাবনাও নেই। এটাকে আমাদের কাছে অশনিসংকেত মনে হচ্ছে।’

শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তি দাবি করেছেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। হৃদয়ের বিরুদ্ধে করা মামলাটি ‘অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম’-এর ওপর আঘাত বলেও মন্তব্য তার।

নিজের ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় মামলা করার পূর্বে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারার বিধান মতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল, যা মানা হয়নি।’

এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বলেও জানান এই আইনজীবী। তিনি লিখেছেন, ‘মুন্সীগঞ্জ সদর থানার মামলা গ্রহণ করারই কোনো এক্তিয়ার ছিল না। যে অভিযোগে মামলা হয়েছে তার সঙ্গে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। এমন এক মামলায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিলেন না কেন, তা বোধগম্য নয়।’

বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। অলংকরণ: মামুন হোসাইন/নিউজবাংলা

কারাগারে হৃদয়, জানেন না বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতারা

দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়া এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমতুল্লাহ বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটি সম্পর্কে আমি জানিই না। যে বিষয় সম্পর্কে আমি জানি না, সে বিষয়ে আমি মন্তব্য করব না।’

সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়াও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি তো আমি শুনিনি। আমি মাত্রই শুনলাম। কবে ঘটেছে এ ঘটনা?’

পরে ঘটনার বিবরণ শোনার পর তিনি বলেন, ‘এগুলো কন্ট্রোভার্সিয়াল বিষয়। ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে জড়িয়ে ওনার এ ধরনের বক্তব্য না দেয়াই বেটার ছিল।’

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় থাকা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আমাদের ৯০ শতাংশ মানুষ যেহেতু মুসলিম, সেখানে ধর্ম নিয়ে কন্ট্রাডিকটরি বক্তব্যটা দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয় বলে আমি মনে করি।’

১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান। তাই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতেও চাননি তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিজ্ঞান তো ধর্মের বিপক্ষে না। কোরআনেও বিজ্ঞানের কথা বলা আছে। সুতরাং বিজ্ঞান ধর্মের পরিপন্থি নয়। যারা ভালোভাবে বিজ্ঞান পড়েন তারা অনেক ধার্মিক হন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম সানা বলেন, ‘একজন শিক্ষক কীভাবে পড়িয়েছেন বা তিনি কীভাবে বিষয়টিকে অ্যাড্রেস করেছেন সেটি তার ব্যাপার। তবে আমি মনে করি, মানব সভ্যতার শুরু থেকেই কিন্তু ধর্মের অস্তিত্ব। বিভিন্ন সময় ধর্মের বিভিন্ন রূপ ছিল। আর বিজ্ঞান বলতে আমরা বুঝি গবেষণালব্ধ জ্ঞান। আর এটি ডেভেলপ হয়েছে আরও অনেক পরে কিন্তু ধর্ম মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল।’

ঘটনার সূত্রপাত

মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে গত ২০ মার্চ দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয়পত্রের ক্লাস শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। এ কারণে গণিত ও বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে ওই ক্লাসে পাঠানো হয়। তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করেন।

আলোচনার সময় গোপনে তার বক্তব্যের অডিও ধারণ করা হয়। প্রায় ১৭ মিনিটের ওই অডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় কয়েকজন ছাত্রকে বারবার ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে প্রশ্ন করতে শোনা যায়। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল ধর্মকে একটি ‘বিশ্বাস’ এবং বিজ্ঞানকে ‘প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলেন। তবে এর আগেই ২২ মার্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা জোটবদ্ধ হয়ে হৃদয় মণ্ডলের শাস্তির দাবিতে স্কুলে মিছিল বের করে।

বিদ্যালয় চত্বরের পার্শ্ববর্তী রিকাবীবাজার এলাকাতেও মিছিল হয়। প্রধান শিক্ষক বিষয়টি সদর থানা ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানোর পর পুলিশ হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে।

এরপর রাতেই বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও কোরআন অবমাননার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করেন। পরের দিন পুলিশ আদালতে তোলার পর বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান।

অভিযোগের সর্বোচ্চ সাজা ২ বছরের জেল

শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় মামলা করা হয়েছে। এই ধারায় ‘কোনো শ্রেণিবিশেষের ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে আবমাননা করে ওই শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষাত্মক কাজের’ সংজ্ঞা ও শাস্তির প্রসঙ্গ রয়েছে।

এই ধারায় বলা হয়, ‘যে ব্যক্তি, বাংলাদেশের নাগরিকদের যে কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর অপমানিত করার অভিপ্রায়ে ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষাত্মকভাবে উচ্চারিত বা লিখিত শব্দাবলির সাহায্যে বা দৃশ্যমান কোনো বস্তুর সাহায্যে ওই শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করে বা অবমাননা করার চেষ্টা করে, সে ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

এ বিভাগের আরো খবর