দেশে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবকাঠামো বাড়লেও সেবার সক্ষমতা বাড়েনি। জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসায় নানামুখী সংকটে পড়ছে রোগীরা। এদের একটি অংশ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছে। তবে বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসায় উচ্চ ব্যয়ের কারণে রোগীদের বড় একটি অংশই স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়াতে সর্বোচ্চ জোর দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে সঠিক সেবা নিশ্চিত করা গেলে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে মানুষ। সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে। দরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের একটি কক্ষে এয়ারকন্ডিশনার (এসি) নষ্ট থাকায় বৈদ্যুতিক পাখা চালিয়ে ভ্যাপসা গরম কোনোভাবেই দূর করা যাচ্ছে না। ওই কক্ষে রোগীদের কারও কারও হাতে দেখা গেছে হাতপাখা, কারও শয্যার কাছে রাখা ছোট্ট টেবিল ফ্যান। ফাইল ছবি
দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ২০১২ সালে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ কর্মসূচি নেয়া হয়। ইতোমধ্যে ১০ বছর পার হলেও তাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরো জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘এই কর্মসূচির গতি বাড়াতে সম্প্রতি একটি বৈঠক করা হয়েছে। তবে সরকারের একার পক্ষে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। দেশে বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশকে স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৬০ শতাংশের চিকিৎসা সেবাও সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিশ্চিত করতে হবে।
‘দেশে জেলায় জেলায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকে যে সার্ভিসটা দেয়ার কথা তা জনগণ এখনও পাচ্ছে না। জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবাটি দেয়া সম্ভব হলে তারা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সরকারি হাসপাতালে সেবায় মানুষের আস্থা ফিরবে। এই ব্যবস্থাপনাটা আগে ঠিক করতে হবে। এই সেবা কেন্দ্রগুলোতে যে দুর্বলতা রয়েছে তা চিহ্নিত করে ট্রাসফোর্স গঠনের মাধ্যমে এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।’
বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে দুই সারিতে শুয়ে আছে রোগী। কেউ আবার মেঝেতে জায়গা না পেয়ে শুয়ে আছেন ট্রলিতে। ফাইল ছবি
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নে আমাদের বেশিকিছু বিষয়ে বাড়তি নজর দেয়া উচিত। প্রথমেই নগরের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের বিষয়ে নজর দিতে হবে। হাসপাতালগুলোতে সেবার মান উন্নত করতে হবে। কারণ হাসপাতালগুলোর অবস্থা এমন যে সেখানে গিয়ে উল্টো অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা রোগ বাঁধিয়ে ফেলেন। নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা বা নৈতিক ব্যবসা নিশ্চিত করার বিষয়টি জরুরি।
‘ওষুধের দামের ওপর কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একে নিয়মনীতির মধ্যে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।’
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যস্তবায়নে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কর্মসূচি চালু হওয়ার পর অনেক সময় চলে গেছে। মাত্র তিনটি জেলায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশে সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে একটি বড় বাধা হলো বৈষম্য। আমরা একটি অসম পৃথিবীতে বসবাস করছি। কিছু মানুষ সুস্বাস্থ্য ও উন্নত জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষ কোনো রকমে বেঁচে থাকতে নিরন্তর যুদ্ধ করছে।
‘কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব, আবাসন সংকট, শিক্ষার ক্ষেত্রে সীমিত সুযোগ, সংকটাপন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, লিঙ্গবৈষম্য, নিরাপদ পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানি, নির্মল বায়ু ও নিরাপদ খাদ্য সংকটসহ নানা সমস্যা বিদ্যমান। এসব সমস্যা মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে কর্মসূচি
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ বৃহস্পতিবার। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘আওয়ার প্লানেট আওয়ার হেলথ অর্থাৎ সুরক্ষিত বিশ্ব, নিশ্চিত স্বাস্থ্য। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় শোভাযাত্রা বের করবে। সকাল ৯টায় শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
এ ছাড়া বেলা ১১টায় ওসমানী মিলনায়তনে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথি থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।