সরকার দলীয় লোকজনের খবরদারিতে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার দুটি ইউনিয়নে টিসিবির কার্ড বিতরণে অচলাবস্থা চলছে। যদিও স্থানীয় প্রশাসন দোষারোপ করছে দুটি ইউনিয়ন পরিষদের বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান-মেম্বারদের। রাজনৈতিক এ টানাপোড়েনে সরকারি বরাদ্দ পেয়েও সুবিধা বঞ্চিত প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ।
কালীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুটি ইউনিয়ন এখনও তালিকা জমা দেয়নি। তাদের শোকজ করা হয়েছে। চেয়ারম্যানদের তাগাদা দেয়া হচ্ছে। আশা করছি দু’একদিনের মধ্যে জমা দিবে।’
এলাকার লোকজনের অভিযোগ, নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরে ঘরে ন্যায্যমূল্যে পণ্য পৌঁছে দিতে সরকার টিসিবির কার্ড দিচ্ছে। দুস্থ ও অভাবীরা যেন উপকৃত হন সেটাই সরকারের লক্ষ্য। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সরকার দলীয় লোকজন এসব কার্ড ভাগ বাটোয়ারা করছেন নিজেদের প্রভাব দেখাতে। এটে অন্য এলাকায় কার্ড বিতরণ শেষ হলেও কালীগঞ্জের দুই ইউনিয়নে প্রায় পাচঁ হাজার মানুষ টিসিবির কার্ড হাতে পাননি। দলগ্রাম ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নে বিএনপির চেয়ারম্যান থাকায় তারাও রাজনৈতিক কারণে সরকার দলীয় লোকজনের খবরদারি মানতে পারছেন না।
ফ্যামিলি কার্ড পেতে ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরছেন অসহায় মানুষ। ছবি: নিউজবাংলা
দলগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান ছোটন বলেন, ‘কালীগঞ্জের সব ইউনিয়নে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে ২০ মার্চ, সেখানে সব কার্ড বিতরণ শেষ হয়েছে। তবে দলগ্রাম ইউনিয়নে কার্ড বিতরণ দূরের কথা, তালিকাই তৈরি হয়নি। চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের গাফিলতির কারণে এ সংকট।’
ছোটন দাবি করেন, সরকারের মহৎ উদ্যোগে কালি লাগাতেই বিএনপির চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ঝামেলা তৈরি করছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু নাম দিয়েছি, তালিকা করেছি। সেটিকে ভিন্ন খাতে নিতে অপপ্রচার চলছে। আমাদেরও তো কিছু লোক আছে, যারা গরীব অসহায়। রমজান মাসে সাধারণ মানুষের হক বঞ্চিত করে এ রাজনীতি চলতে পারে না। আগেও আওয়ামী লীগের লোকজনকে বাদ দিয়ে তালিকা হয়েছে। এবার আগের বঞ্চিতদেরসহ একটি তালিকা করে টিসিবির পণ্য বিতরণের জন্য আমরা বলে আসছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা লোকমান হোসেন বলেন, ‘আমরা এখনও টিসিবির কার্ড পাইনি। রমজান মাস শুরু হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। সরকারি সহায়তার এসব কার্ড চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমেই বিতরণ হয়ে থাকে, কিন্তু এবার দেখছি ভিন্ন।
‘আওয়ামী লীগের নেতারা অর্ধেক কার্ড চাওয়ায় নাকি চেয়ারম্যান তালিকা জমা দিতে রাজি হননি। নিজেরা একটু মিলমিশ করে কাজ করলে এমন অবস্থা হত না।’
টিসিবি পণ্যের মূল্যতালিকা। ছবি: নিউজবাংলা
দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিসিবির কার্ড নিয়ে যেদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে মিটিং হয়, সেদিন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সমন্বয় করে তিনি টিসিবির কার্ড বিতরনের কথা বলেছিলেন।
‘সমন্বয় মানে তো অর্ধেক ভাগাভাগি নয়। স্থানীয় নেতারা এখন অর্ধেক ভাগ চাচ্ছেন দলীয় লোকজনকে দেয়ার জন্য। আমি বিতরণ করলে শতভাগ করবো, তাদের ৩০ শতাংশ নাম থাকতে পারে। না হলে পুরো তালিকা তারা করে দিতে পারে, আমার দায় থাকবে না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে চেয়ারম্যান বলেন, ‘পরিষদের ১২ সদস্য ও আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। সারা দেশে চেয়ারম্যানদের নামেই সরকারি বরাদ্দ আসে, কিন্তু এখানে সব উল্টো। নতুন ও পুরোনো তালিকা মিলিয়ে ইউনিয়নে প্রায় আড়াই হাজার টিসিবির কার্ড দেয়ার কথা। অথচ সরকারি দলের নেতা আগেই পাঁচ শ জনের তালিকা জমা দিয়ে বসে আছেন। তারা নতুন কার্ডের ৫০ শতাংশ ভাগ দিতে হবে বলে দাবি জানাচ্ছেন।
‘চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের যদি না লাগে, তারাই সব তালিকা করুক। জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে হলে আমাদের নতুন ১ হাজার ১৭৮ জনের তালিকা করার অধিকার থাকতে হবে। এরকম পরিস্থিতির কারণে টিসিবির তালিকা করিনি। ইউএনও তালিকা জন্য তাগাদা দিলেও ভাগাভাগির বিষয়ে কথা বলেন না। আমরা একটা তালিকা করছি, তা জমা নিলে নেবে, না হলে এ ঝামেলায় আমরা নেই।’
ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রম উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক। ছবি: নিউজবাংলা
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, লালমনিরহাট জেলার ৫ উপজেলা ও ২ পৌরসভার জন্য মোট ১ লাখ ১ হাজার ৯৪০টি ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা হবে। দু’সপ্তাহ আগেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নে এখনও টিসিবি পণ্যের ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ ও পণ্য বিক্রি শুরু করা যায়নি। এতে বঞ্চিত রয়েছে সুবিধাভোগী প্রায় ৫ হাজার পরিবার।
গত ২০ মার্চ লালমনিরহাটে ২১ জন ডিলারের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রম উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর। এতে পাঁচটি উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় মোট ১ লাখ ১ হাজার ৯৪০টি ফ্যামিলি কার্ডের বিপরীতে টিসিবি পণ্য দেয়ার কথা।
ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ নিয়ে সংকটের কথা জানিয়ে চন্দ্রপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. সোহেল রানা বলেন, ‘টিসিবির পণ্য সব ইউনিয়নে বিতরণ শেষ, কিন্তু চন্দ্রপুরে দলীয় ভাগ নিয়ে বিরোধে শুরু হয়নি। সমঝোতার অভাবে কার্ড বিতরণ আটকে আছে।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, ‘অর্ধেক ভাগ চাওয়ায় চেয়ারম্যান বেঁকে বসেছেন। তিনি সব কার্ডের দায়িত্ব না পেলে তালিকা করতে রাজি নন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সুপারিশ থাকলে, সে নামও তার কাছে জমা দিতে বলেছেন।’
৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আবু সাঈদ বলেন, ‘টিসিবির কার্ড বিতরণের জন্য আমরা চিঠি বা কাগজপত্র পাইনি। নির্দেশনার অভাবে তালিকা তৈরি করিনি, চিঠি পেলে সে মোতাবেক তালিকা জমা দেব।’
চন্দ্রপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা বিএনপির চেয়ারম্যান বলে অর্ধেক ভাগ, আর সরকার দলীয়রা পাচ্ছেন শত ভাগ। এটি অন্যায়। আমি সরকার দলীয় লোকদের ৩০ শতাংশ সুযোগ দিয়ে তালিকা করছি, দেখি কি হয়।’