পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের পুঁজিবাজারে মন্দাভাবের মধ্যে হঠাৎ ব্যাপক চাঙাভাব দেখা দিয়েছে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোকে নিয়ে গঠন করা এসএমই বোর্ড।
এই বোর্ডের ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৯টির দর লাফাচ্ছে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে একটি ছাড়া সব কটির শেয়ারদর কমপক্ষে দ্বিগুণ হয়েছে। অন্য একটির দর এই সাত দিনের আগের ১০ কর্মদিবসে আড়াইগুণের মতো বেড়েছে।
এক মাসের মধ্যে এই কোম্পানিগুলোর কোনোটির তিন গুণ, কোনোটির প্রায় চার গুণ হয়ে গেছে।
তবে আরেক কোম্পানি হিমাদ্রির লেনদেন হচ্ছে না বললেই চলে। এই কোম্পানটির ৯৯ শতাংশেরও বেশি শেয়ার মালিকপক্ষের হাতে। বাকি শেয়ারের সংখ্যা হাজারের ঘরেও না।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর এসএমই বোর্ড চালুর আগে থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বেশ আশাবাদী ছিল। এই বোর্ডের কোম্পানির শেয়ারদর এক দিনে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি বা কমার সুযোগও রাখা হয়, যেখানে মূল বাজারে এক দিনে শেয়ারদর বৃদ্ধি বা হ্রাস হওয়া সম্ভব সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ।
তবে চলতি বছরের মার্চের শুরু পর্যন্ত এই এমএসই বোর্ডে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল সীমিত। শুরুতে বিএসইসি জানায়, এই বাজারে কেবল যোগ্য বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করতে পারবে যাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কম পক্ষে এক কোটি টাকা।
এই বোর্ড উদ্বোধন করা হয় ছয়টি কোম্পানি নিয়ে। এর মধ্যে চারটি ওটিসি ফেরত, দুটি নতুন তালিকাভুক্ত। পরে আরও চারটি নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়।
ওটিসির সব কটি কোম্পানি তো বটেই এমনকি নতুন তালিকাভুক্ত পাঁচটি কোম্পানির বেশ কয়েকটি অভিহিত মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমে আসে, যদিও কোম্পানিগুলো আগামী তিন বছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেবে- এমন শর্ত আছে।
যোগ্য বিনিয়োগকারীর শর্ত শিথিল করার সিদ্ধান্ত জানানোর দিন ২৮ মার্চ এসএমইতে লেনদেন হয় ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। পরের দিনই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ২০ লাখ ৮৩ হাজারে। এর পরের দিন লেনদেন বাড়ে আরও এক কোটি টাকার কাছাকাছি। হাতবদল হয় ৬ কোটি ৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা। ওই সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবারে লেনদেন গিয়ে ঠেকে ১২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৬ হাজারে।
কিন্তু বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম থাকায় শেয়ারের লেনদেন হতে থাকে খুবই কম। এরপর লেনদেন বাড়াতে এক পর্যায়ে বিনিয়োগের পরিমাণ এক কোটি থেকে কমিয়ে ৫০ লাখে নামায় বিএসইসি।
যাদের এই পরিমাণ বিনিয়োগ আছে, তারা যোগ্য বিনিয়োগকারী হিসেবে আবেদন করবেন, এরপর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে এসএমই বোর্ডে বিনিয়োগের অনুমতি দেবে- এমন একটি পদ্ধতি চালু করা হয়।
কিন্তু এবারও বিনিয়োগকারীর খরায় ভুগতে থাকে এসএমই বোর্ড। তবে সব কিছু পাল্টে যায় গত ২৮ মার্চ। ১৭ মার্চ বিএসইসি যোগ্য বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা নামিয়ে আনে ২০ লাখ টাকায়। এর ১১ দিন পর জানানো হয়, যোগ্য বিনিয়োগকারী হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে না।
আবার তালিকাভুক্ত হতে নিবন্ধনের শর্ত তুলে দেয়া হয়। নতুন সিদ্ধান্ত কারও পোর্টফোলিওতে ২০ লাখ টাকার বিনিয়োগ (ক্রয় মূল্য বা বাজার দরের সর্বোচ্চটা বিবেচ্য) থাকলেই ডিএসই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধন করে দেবে।
এর ফলে বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারীর এসএমই বোর্ডে বিনিয়োগের যোগ্য হয়। আর মূল বাজারে মন্দাভাবের কারণে তারা এই বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে।
এসএমই বোর্ডে শেয়ারদর লাফালেও মূল বাজারে মন্দাভাবের কারণে বিনিয়োগকারীদের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে
বাড়ছে বিনিয়োগ
বিনিয়োগ সহজ করার আগে যেখানে লেনদেন এক কোটি টাকার আশেপাশে ওঠানামা করত, সেখানে বুধবার হাতবদল হয়েছে ৩৮ কোটি ২০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। আগের দিন লেনদেন ছিল ৩৩ কোটি ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
যোগ্য বিনিয়োগকারীর শর্ত শিথিল করার সিদ্ধান্ত জানানোর দিন ২৮ মার্চ এসএমইতে লেনদেন হয় ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। পরের দিনই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ২০ লাখ ৮৩ হাজারে।
এর পরের দিন লেনদেন বাড়ে আরও এক কোটি টাকার কাছাকাছি। হাতবদল হয় ৬ কোটি ৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা।
ওই সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবারে লেনদেন গিয়ে ঠেকে ১২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৬ হাজারে।
এটা পাগলামো ছাড়া কিছুই নয়। এটা কোনো যৌক্তিক কারণে হতে পারে না। লেনদেন সীমা কমিয়ে দিয়ে ইনভেস্টরদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একদিনেই দর বাড়ছে ২০ শতাংশ করে। পরে দেখা যাবে বিমার শেয়ারের মতো দাম বাড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে কেটে পড়বে মালিকরা। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির লোক পাবে না: অধ্যাপক আবু আহমেদ
তবে চলতি সপ্তাহের প্রথম দিনে লেনদেন কমে হয় ৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। তবে পরের দিনই লাফ দিয়ে তিনগুণ বেড়ে যায়। সোমবার লেনদেন দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৫৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকায়।
টানা কয়েক দিন বাড়ার পর বুধবার চারটি কোম্পানির দর কিছুটা সংশোধন হয়। বাকি পাঁচটির দাম আরও বেড়েছে।
এই দর বৃদ্ধির প্রভাবে এক মাসেরও কম সময়ে সূচক বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়ে গেছে। গত ১০ মার্চ সূচক ছিল ৫৮২ পয়েন্ট। সেটি এখন দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩০ পয়েন্টে।
শেয়ারদর বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে
১ ফেব্রুয়ারি ১০ টাকায় লেনদেন শুরু করা নিয়ালকো অ্যালয়েজ লিমিটেডের শেয়ারদর গত ৮ মার্চও ছিল ১১ টাকা। সেখান থেকে ২০ মার্চ বেড়ে হয় ১৪ টাকা ৬০ পয়সা। সেখান থেকে বেড়ে ২৮ মার্চ হয় ১৮ টাকা ৫০ পয়সা।
এসএমই বোর্ডে বিনিয়োগ সহজ করার পর দিন থেকে শুরু হয় লাফ। সাত কর্মদিবসে এখান থেকে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাম দাঁড়িয়েছে ৪৪ টাকা ৬০ পয়সা।
অর্থাৎ এক মাসেরও কম সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে চার গুণেরও বেশি।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে লেনদেন শুরু করা মাস্টার ফিড অ্যাগ্রোটেকের শেয়ারদর গত ১০ মার্চ নেমে আসে ৮ টাকা ৩০ পয়সায়। ২৮ মার্চ সেখান থেকে কিছুটা বেড়ে হয় ১০ টাকা ১০ পয়সা।
পরের সাত দিনে সেখান থেকে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয় ২০ টাকা ৬০ পয়সা। এই কোম্পানির শেয়ারদরও এক মাসের মধ্যে প্রায় আড়াই গুণ হয়ে গেছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর লেনদেন শুরু করা অরিজা অ্যাগ্রোর শেয়ারদর গত ৮ মার্চ নেমে আসে ৭ টাকা ৯০ পয়সা। গত ২৮ মার্চ দর কিছুটা বেড়ে অভিহিত মূল্যে ছাড়িয়ে হয় ১০ টাকা ১০ পয়সা। এরপর দেয় লাফ। এই কোম্পানির শেয়ারদর এখন ২২ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ এক মাসের কিছু বেশি সময়ে শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর এসএমই বোর্ড চালু হয় ছয়টি কোম্পানি নিয়ে। বর্তমানে সেখানে কোম্পানির সংখ্যা ১০টি
গত ৩ নভেম্বর লেনদেন শুরু করা কৃষিবিদ ফিডের শেয়ার অভিহিত মূল্যের অনেকটাই নিচে নেমে আসে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন শেয়ারদর দাঁড়ায় ৮ টাকা ৪০ পয়সা। গত ২৮ মার্চ সেখান থেকে দর কিছুটা বেড়ে হয় ১০ টাকা ২০ পয়সা। সাত কর্মদিবসেই সেখান থেকে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ২১ টাকা ১০ পয়সা।
গত ১৭ অক্টোবর লেনদেন শুরু করা মোস্তফা মেটালের শেয়ারদর প্রথম দিন বাড়ে ২০ শতাংশ। তবে গত ২০ মার্চ দাম অভিহিত মূল্যের চেয়ে নিতে নেমে আসে। সেদিন দর দাঁড়ায় ৯ টাকা ৯০ পয়সা।
২৮ মার্চ যেদিন এই বোর্ডে বিনিয়োগ সহজ করার সুযোগ দিয়ে আদেশ আসে, সেদিনও দর ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা। এরপর সাত কর্মদিবস পরে দাম দাঁড়িয়েছে ২৪ টাকা ৫০ পয়সা।
এক মাসেরও কম সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি লেনদেন শুরু করা মামুন অ্যাগ্রোর দর ২৮ মার্চ ছিল ১০ টাকা ১০ পয়সা। এর পরের সাত কর্মদিবসে সেখান থেকে দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা ৩০ পয়সা।
ওটিসিফেরত কোম্পানিগুলোর কী চিত্র
ওটিসি থেকে এসএমই মার্কেটে ফিরেই লাফাচ্ছিল ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েজের দর। ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম দিন প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে শেয়ারদর হয় ১৯ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে দাম বেড়ে ৮ ডিসেম্বর হয় ১১০ টাকা। এরপর তা কমতে থাকে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তা নেমে আসে ১৪ টাকায়।
২৮ মার্চ শেয়ারদর দাঁড়ায় ২৩ টাকা ৫০ পয়সা। এর পরের সাত কর্মদিবসে দাম আড়াইগুণেরও বেশি বেড়ে হয়েছে ৬১ টাকা ৯০ পয়সা।
গত এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়ে হয়েছে তিন গুণ।
ওটিসিফেরত কোম্পানিগুলোর দর শুরুতে বেড়ে পরে কমে গিয়েছিল। আবার তা বাড়ছে ২৮ মার্চের পর থেকে
বেঙ্গল বিস্কুটের শেয়ারদর লেনদেন শুরু করার দিন ছিল ২১৩ টাকা ৩০ পয়সা। এটিই সর্বোচ্চ দর নিয়ে ফিরেছিল। সেখান থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই হয়ে যায় ২৪৯ টাকা ৬০ পয়সা। তবে গত ১২ ডিসেম্বর শেয়ারদর নেমে আসে ৭১ টাকা ৩০ পয়সায়। গত ২৮ মার্চ শেয়ারদর ছিল ১০২ টাকা। সেটি এখন ২০১ টাকা ৪০ পয়সায়।
আরেক কোম্পানি অ্যাপেক্স উইভিং ৩০ মার্চ ১৪ টাকা ৪০ পয়সা। তবে গত ১৩ মার্চ দাম কমে হয় ৫ টাকা ৬০ পয়সা। ২৮ মার্চ সেখান থেকে দাম তিন গুণ হয়ে যায়; ১৬ টাকা ১০ পয়সা। এখন দাম দাঁড়িয়েছে ২২ টাকা ৭০ পয়সা, যদিও বুধবার দর কমেছে ১১ টাকা ৩২ শতাংশ।
অর্থাৎ এক মাসের কম সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার দর চার গুণেরও বেশি বেড়েছে।
‘পাগলামো চলছে’
এসএমই বোর্ডের কোম্পানির শেয়ারদরে এভাবে উল্লম্ফন নিয়ে সতর্ক করেছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ।
এই বাজারে এক দিনে যেমন ২০ শতাংশ দাম বাড়তে পারে, তেমনি ২০ শতাংশ কমতেও পারে-এই বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা পাগলামো ছাড়া কিছুই নয়। এটা কোনো যৌক্তিক কারণে হতে পারে না। লেনদেন সীমা কমিয়ে দিয়ে ইনভেস্টরদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একদিনেই দর বাড়ছে ২০ শতাংশ করে। পরে দেখা যাবে বিমার শেয়ারের মতো দাম বাড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে কেটে পড়বে মালিকরা। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির লোক পাবে না।’
মূল মার্কেট শেয়ারদর বৃদ্ধির সীমা ১০ শতাংশ হলেও এসএমইতে তা কেন ২০ শতাংশ হবে- সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি। বলেন, ‘আসল মার্কেটে কেন শেয়ারদর বাড়তে দিচ্ছে না? বিএসইসি কেন যে এসব সিদ্ধান্ত নেয় তা বোঝে আসে না।’