জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে সমন্বিত একটি তামাক করনীতি প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী। সেটি পূরণেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বরং দেশে বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য আরও সহজলভ্য হচ্ছে। ফলে ক্রমাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার পূরণ ও নির্দেশ বাস্তবায়নে সমন্বিত একটি তামাক করনীতি প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার গবেষণা ও তামাকবিরোধী অ্যাডভোকেসি সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি-টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের (আত্মা) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সভায় এ দাবি জানান তারা।
এতে সংসদ সদস্য, সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখেন।
আলোচকরা বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে দেখা যায়, কর হার বেশি হলে তামাকজাত পণ্যের দামও বেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টো। এখানে কর বেশি, কিন্তু সিগারেটের দাম কম। এমন ‘ভৌতিক কর কাঠামো’ বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকপণ্য সস্তা।
তামাকপণ্যের করনীতি বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভূমিকার সমালোচনা করে বক্তারা আরও বলেন, এনবিআর খুবই সংরক্ষণশীল জায়গা। কর্মকর্তারা যা বোঝেন, তাই করেন। নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসতে চান না। তাদের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন দরকার।
বর্তমান তামাক খাতে ‘অ্যাড-ভ্যালোরেম’ নামে যে পদ্ধতিতে রাজস্ব আহরণ করা হয়, তার পরিবর্তন করে বিড়ি-সিগারেটসহ সব তামাকপণ্যে ‘সুনির্দিষ্ট কর’ আরোপের দাবি জানিয়েছেন বিশেজ্ঞরা।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, বিদ্যমান তামাক করকাঠামো অত্যন্ত জটিল, যা তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে যথেষ্ট নয়। সিগারেটে বহু স্তরবিশিষ্ট করকাঠামো চালু থাকায় বাজারে অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য সিগারেট বিদ্যমান। ফলে ধূমপান ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে ভোক্তা তুলনামূলকভাবে কম দামি সিগারেট বেছে নিতে পারছে।
এক স্তরবিশিষ্ট সুনির্দিষ্ট করকাঠামো পদ্ধতি চালু করা হলে সিগারেটের ব্যবহার কমবে। পাশাপাশি বাড়বে সরকারের রাজস্ব আহরণ।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার। তিনি জানান, বর্তমানে বিশ্বের ৬৫টি দেশে তামাক খাতে সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি চালু রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আটটি দেশে এ পদ্ধতিতে কর আহরণ করা হয়। এর ফলে ওইসব দেশে একদিকে যেমন তামাকপণ্যের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে সরকারের রাজস্ব আহরণ। কাজেই বাংলাদেশ তামাক খাতে ‘সুনির্দিষ্ট কর’ ব্যবস্থা চালু করে অধিক রাজস্ব আহরণের সুযোগ রয়েছে।
সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত এমপি বলেন, ‘আগে জনপ্রতিনিধিরা তামাকের ওপর যাতে কর না বাড়ানো হয়, সে জন্য সরকারের সঙ্গে লবিং করতেন। এখন মানসিকতা বদলেছে। তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে কাজ করছেন তারা।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সহজ করকাঠামো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো ঘোষণা দেন, তখন সেটা পালন করা সরকারের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনে যারা গাফিলতি করেন, তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, এনবিআর খুবই সংরক্ষণশীল জায়গা। কর্মকর্তারা যা বোঝেন, তাই করেন। তাদের নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে চান না।
তিনি মনে করেন, তামাকের শুধু মূল্যবৃদ্ধি করলে হবে না, তার সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে হবে।
তামাক খাতে পৃথক করনীতি প্রণয়নে সব মহলের চাপ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং টিভি টুডের এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘এত বছরেও তামাক খাতে করনীতি হয়নি, এটা খুবই হতাশাজনক। তবে আশার আলো হচ্ছে, বর্তমানে বেশির ভাগ সাংসদ এ বিষয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসছেন।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক সৈয়দ ইউসুফ সাদাত বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সিগারেটের দাম কম। ফলে এখানে আরও দাম বাড়ানোর সুযোগ আছে। সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে এটা করা সম্ভব।’
তামাক খাতে একটি সহজ করকাঠামো তৈরির প্রস্তাব করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর।
তামাকবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট সব মহলকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার আহবান জানান ঢাকা আহছানিয়া মিশনের হেলথ ও ওয়াশ সেক্টর পরিচালক ইকবাল মাসুদ।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাবেক অতিরিক্ত সচিব রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমরা যা প্রস্তাব দিই, এনবিআর কখনই তা আমলে নেয় না।’
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে), বাংলাদেশ-এর লিড পলিসি অ্যাডভাইজার ও বিসিআইয়ের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে তামাক করনীতি প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’