তেজগাঁও কলেজের মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দারকে হেনস্তায় অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেক ইতোমধ্যে শনাক্ত হয়েছেন। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে অভিযোগের তদন্তও শুরু হয়েছে।
কনস্টেবল নাজমুল যে মোটরসাইকেলের আরোহী ছিলেন, সেটি চোরাই বলে দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টে। অন্তত একটি টেলিভিশনসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হয় একই তথ্য।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নাজমুলের মোটরসাইকেলটি চোরাই নয়। তিনি মাসিক কিস্তিতে যশোরের একটি শোরুম থেকে এটি কেনেন এবং এর নিবন্ধনও হয় যশোর বিআরটিএতে।
কপালে টিপ পরে হেঁটে যাওয়ার সময় রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় লাঞ্ছিত ও হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হওয়ার অভিযোগ তুলে শনিবার শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন কলেজশিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার।
অভিযোগে লতা বলেন, টিপ পরায় এক পুলিশ সদস্য তাকে উত্ত্যক্ত করেন। প্রতিবাদ করলে তাকে মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টাও করেন সেই ব্যক্তি। পুলিশ সদস্যের দেহের গড়ন বলতে পারলেও তখন তার নাম জানাতে পারেননি ওই শিক্ষক।
সোমবার সকালে কনস্টেবল নাজমুল তারেককে শনাক্ত করার কথা জানায় পুলিশ। অভিযোগে লতা নাজমুলের নাম, পদবি বা কর্মস্থল উল্লেখ করতে না পারলেও তার দেহের গড়ন ও ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর উল্লেখ করেন। মোটরসাইকেলের সেই নম্বরটি হলো ১৩৩৯৭০।
তবে এ নম্বরটি পরিপূর্ণ নয়। কারণ এই সিরিয়াল নম্বরের আগে বিআরটিএ অঞ্চলের নাম ও মোটরসাইকেলের অশ্বশক্তি নির্ধারণ ক্যাটাগরির কোনো অক্ষর উল্লেখ করা ছিল না।
এ ধরনের পোস্ট ছড়িয়েছে ফেসবুকে
ঘটনার তুমুল সমালোচনার মধ্যে ওই পুলিশ সদস্যকে খুঁজে বের করতে কাজ শুরু করে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ ও শেরেবাংলা নগর থানা। আশপাশের বিপণিবিতান ও দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ ও মোটরসাইকেলের নম্বর ধরে খোঁজখবর নেয়া হয়।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাস্থল ঢাকায় হওয়ায় প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের ১৩-৩৯৭০ নম্বর ধরে বিআরটিএতে খবর নেয়। সেখানে দুটি মোটরসাইকেলের সন্ধান পাওয়া যায়। একটি ঢাকা মেট্রো ল-১৩-৩৯৭০, অন্যটি ঢাকা মেট্রো হ-১৩-৩৯৭০।
‘এই মোটরসাইকেল দুটির কোনোটিই পুলিশ সদস্যের নয়। একটি মালিক নিজে ব্যবহার করলেও অন্যটি চুরি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে থানায়।’
কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সেই চুরি হওয়া মোটরসাইকেলটি কনস্টেবল নাজমুল ব্যবহার করছেন ধরে নিয়ে সংবাদ প্রচার করে। আর এর পরই নাজমুলের ‘চোরাই’ মোটরসাইকেলের তথ্য ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, ঘটনার দুদিন পর রোববার রাতে সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত হন কনস্টেবল নাজমুল তারেক। এরপর তার কাছে যে মোটরসাইকেলটি পাওয়া যায় তার নম্বর হলো, যশোর ল ১৩-৩৯৭০। অর্থাৎ মোটরসাইকেলের সিরিয়াল নম্বর ঠিক থাকলেও এর অঞ্চল যশোর ও অশ্বশক্তি নির্ধারণী অক্ষর হলো ‘ল’।
এ ধরনের পোস্ট ছড়িয়েছে ফেসবুকে
এই নম্বর ধরে যাচাই করে মোটরসাইকেলটি কনস্টেবল নাজমুল তারেকের নিজের বলেই তথ্য পেয়েছে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কনস্টেবল নাজমুল তারেকের মোটরসাইকেলটি তার ব্যক্তগত। তিনি এটি যশোরের একটি শোরুম থেকে মাসিক কিস্তিতে কিনেছিলেন এবং যশোর বিআরটিএতে রেজিস্ট্রেশন করা।’
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার রুবাইয়াত জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী নারী নিশ্চিতভাবে মোটরসাইকেলের নম্বর উল্লেখ করতে না পারায় প্রথমে ঢাকা মেট্রো বিআরটিএতে ওই সিরিয়াল নম্বর দিয়ে খোঁজা হয়েছিল। এ বিষয়ে সাংবাদিকদেরও সঠিক তথ্য দেয়া হয়েছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে কখনই বলা হয়নি, ওই কনস্টেবল চোরাই মোটরসাইকেল ব্যবহার করছিলেন। বরং কনস্টেবল নাজমুলের মোটরসাইকেলটি মাসিক কিস্তিতে যশোর থেকে কেনা এবং সেখানেই রেজিস্ট্রেশন করা।’
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কনস্টেবল নাজমুলের মোটরসাইকেলটি চোরাই নয়, এটি সম্পূর্ণ বৈধ একটি মোটরসাইকেল। আমরা যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয়েছি। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’
ডিএমপির উপকমিশনার পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার দুটি মোটরসাইকেলের মধ্যে একটি চোরাই। সেটির বিষয়ে মালিক থানায় জিডিও করে রেখেছেন। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, নাজমুল যে মোটসাইকেলটি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে যাচ্ছেন, সেটির সঙ্গে ঢাকার সিরিয়াল নম্বরের দুটি মোটরসাইকেলের কোনো মিল নেই। তখনই আমরা নিশ্চিত হই চোরাই মোটরসাইকেল ব্যবহারের বিষয়টি অমূলক।’
বিষয়টি নিয়ে বিআরটিএতেও খোঁজ নিয়েছে নিউজবাংলা। দেখা গেছে, যশোর ল-১৩-৩৯৭০ নম্বর দিয়ে মোটরসাইকেলটির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে নিলয় মোটরস লিমিটেডের নামে। ২০২০ সালের ১৯ মার্চে এই রেজিস্ট্রেশন হয়। ২০১৯ মডেলের বাইকটি ১৫০ সিসি অশ্বশক্তির। যে ফোন নম্বর ব্যবহার করে প্রতি বছর মোটরসাইকেলের ট্যাক্স জমা দেয়া হয়েছে সেটি কনস্টেবল নাজমুল তারেকের।
নিলয় মোটরের যশোর বিভাগের জোনাল ম্যানেজার আবু সাইদ নিউজবাংলাকে বলেন, “মোটরসাইকেলটি ২০২০ সালে নাজমুল তারেক নামে একজন কিনেছিলেন। এটি হিরো হোন্ডা কোম্পানির মোটরসাইকেল। নিলয় মোটরসের ‘আমার হিরো’ নামের কিস্তি প্যাকেজের আওতায় মোটরসাইকেলটি কেনেন নাজমুল তারেক।”