বরগুনার বামনা উপজেলার একটি আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে চাকরি দেয়ার কথা বলে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
পরে সেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল হলে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এই বিজ্ঞপ্তি গোপন রেখে নিজের কয়েকজন আত্মীয়কে নিয়োগের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
আগে যারা টাকা দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছেন, তিনি টাকা ফেরত নিয়ে এসেছেন। একজন বলেছেন, তিনি টাকা ফেরত চেয়েছেন। একাধিকজন শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন।
শিক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি ব্যবস্থা নেবেন। তবে এখনও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর কাকচিড়া আলিম মাদ্রাসায়। অভিযোগ উঠেছে অধ্যক্ষ শরীফ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সামনাসামনি কথা বলবেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন। এরপর ফোন বন্ধ করে রাখেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল ও নতুন করে বিজ্ঞপ্তি
২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পত্রিকায় অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী, নিরাপত্তাকর্মী, আয়া ও নৈশ প্রহরীসহ মোট চারটি পদে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
সে সময় অফিস সহকারী পদে নিয়োগে ঘুষ দাবির অভিযোগ এনে আল-আমিন নামের একজন নিয়োগ কমিটির বিরুদ্ধে মামলা করে দেন। আদালত নিয়োগ স্থগিত করে দিলে আল-আমিনকে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর বিষয়টির আপস হয়।
এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় দৈনিক সাগকূল ও জাতীয় দৈনিক জবাবদিহিতে ওই চারটি ছাড়াও কম্পিউটার অপারেটর পদে পুনর্নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
অখ্যাত এসব দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিষয়টি গোপন রেখে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ ওঠে অধ্যক্ষ শরীফ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে।
দক্ষিণ কাকচিড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. সামসুজ্জামান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে এই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা যা বলছেন
সামসুজ্জামান নিজেও একজন প্রার্থী। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পর আমি অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী পদের জন্য আবেদন করি। পরে অধ্যক্ষ শরীফ আবদুল্লাহ আমাকে ডেকে চাকরির জন্য পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন।
‘আমি চাকরির আশায় ওই সময় তাকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। নিয়োগ স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, পুনর্নিয়োগের সময় ফের আবেদন করতে। কিন্তু তিনি এটা গোপন রেখেছেন। যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন তা কেউ চেনে না, জানে না। এমনকি মাদ্রাসার নোটিশ বোর্ডেও কোনো নোটিশ দেয়া হয়নি।
‘আমি খবর জেনে আবেদন করতে গেলে অধ্যক্ষ আবেদন না রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। পরে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সাইতুল ইসলাম লিটু মৃধার কাছে ফোন করে জানতে পারি যে আবেদন করার মেয়াদ শেষ।’
এরপর আবার অধ্যক্ষর সঙ্গে যোগাযোগ করেন সামসুজ্জামান। তার দাবি, তখন তার দেয়া টাকা ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেন অধ্যক্ষ।
এই তরুণ জানাচ্ছেন, ২০২০ সালে তার মতো একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন অধ্যক্ষ শরীফ। নতুন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তাদের বাদ দিয়ে বেশি টাকা নিয়ে নতুন করে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেয়ার পাঁয়তারা করছেন তিনি। এ কারণে তিনি আগের আবেদনকারীদের কাছে নতুন করে বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি গোপন রেখেছেন।সামসুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জমি বিক্রি, ধারদেনা করে দুই বছর ধরে চাকরির জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু অধ্যক্ষ প্রতারণা করেছেন। বিধিবহির্ভূতভাবে তিনি তার চাচাতো ভাই আল-আমিনকে ওই পদের জন্য নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন।
‘বাকি পদগুলোতেও চাচাতো ভাই, চাচাতো ভাইয়ের ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়োগ দেয়ার পাঁয়তারা করছেন।’
একই এলাকার আরেক চাকরিপ্রত্যাশী হাফিজা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই বছর আগে আয়া পদের জন্য আমি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। আজ-কাল-পরশু চাকরি হবে বলে এখন তিনি তার আত্মীয়কে বেশি টাকা নিয়ে নিয়োগ দিচ্ছেন।’
এলাকার আরেক বাসিন্দা আমেনা বেগমও জানান, তিনিও আয়া পদের জন্য আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিলেন। বলেন, ‘এখন শুনি নতুন করে অন্য কাউকে নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন।’
পারভীন বেগম নামে আরেক চাকরিপ্রার্থী জানান, তার কাছ থেকে নেয়া হয়েছিল দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। বলেন, ‘পরে জানতে পারি, অধ্যক্ষের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে ডালিয়ার কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন। বিষয়টি জেনে আমি তার কাছ থেকে টাকা ফেরত এনেছি।’নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন দাতা সদস্য জানান, ‘আগেও একই কাজ করেছেন অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ। মাদ্রাসায় কৌশলে শিক্ষক হিসেবে নিজের বোনজামাই আজিজ খান ও আবু সালেহ, শ্যালক মাহবুবুর রহমান, ভাগনে মামুন মিয়া, চাচা হেমায়েত হোসেন, চাচাতো ভাই ইরতিজা হাসানকে নিয়োগ দিয়েছেন।
‘এ ছাড়া করণিক পদে চাচাতো ভাই সিদ্দিকুর রহমান ও দপ্তরি পদে আরেক চাচাতো ভাই মো. মিরাজকে নিয়োগ দিয়েছেন। এবারও একইভাবে বাইরের লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের সুবিধার্থে আত্মীয়দের নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন।’
অধ্যক্ষ বললেন কথা হবে সামনাসামনিএ বিষয়ে জানতে গত বৃহস্পতিবার উত্তর কাকচিড়া আলিম মাদ্রাসায় গেলে অধ্যক্ষ শরীফ আবদুল্লাহকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের পর তিনি বলেন, ‘নিয়োগ যথাযথ প্রক্রিয়াতেই হবে।’
টাকা নেয়ার অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, ‘দেখা করে সামনাসামনি কথা বলব।’
পরে ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখেন।ওই মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও বামনা উপজেলা চেয়ারম্যান সাইতুল ইসলাম লিটু মৃধা বলেন, ‘নিয়োগের বিষয়টি অধ্যক্ষই ভালো জানেন। আমি শুনেছি, নিয়োগপ্রক্রিয়া চলছে এবং ঘুষ নেয়ার বিষয়েও চাকরিপ্রার্থীদের অনেকে আমার কাছে জানিয়েছে। নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাতিল করা হবে।’
তদন্ত করে ব্যবস্থার আশ্বাসজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি এখনও কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’