বাঙালির সবচেয়ে বড় সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ দোরগোড়ায়। আর মাত্র ১০ দিন। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ১৪২৯ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে আনন্দে মাতবে সারা দেশ। আর বর্ষবরণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আনুষ্ঠানিকতা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা এখন বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছর নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এবার রাজপথে নামবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। তার প্রস্তুতিও চলছে জোরেশোরে।
রোববার বিকেলে চারুকলা অনুষদ ঘুরে দেখা গেল মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা।
চারুকলার প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই জয়নুল গ্যালারির মুখে দেখা গেল ছবি আঁকছেন একদল শিক্ষার্থী। জলরঙ ও অ্যাক্রেলিকে বিভিন্ন আকার ও রকমের চিত্রকর্ম আঁকছেন তারা।
পাশেই আরেক দল শিক্ষার্থী ব্যস্ত সরাচিত্র নিয়ে। মাটির সরায় নানা রঙে কেউ ফুটিয়ে তুলছেন মাছ-ময়ূর-পাখির মুখ, কেউবা আঁকছেন ফুল-লতাপাতাসহ নানা মোটিভ।
জয়নুল গ্যালারির এক কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা গেল বাঘ-সিংহ-হাতি ও পেঁচাসহ নানা কিছুর লোকজ ফর্মের মুখোশে রঙ করতে ব্যস্ত আরেক দল শিক্ষার্থী।
চারুকলার জয়নুল স্কুল ঘরে গিয়ে দেখা গেল আরেক চিত্র। এখানে বেশ ক’জন শিক্ষার্থী মাউনবোর্ড দিয়ে ছোট ছোট পাখি বানাচ্ছেন। একইসঙ্গে তাতে রঙ লাগানো হচ্ছে। সে সঙ্গে রয়েছে হাতপাখা আর চরকি।
এদিকে মাঠের মধ্যে বাঁশ দিয়ে কিছু একটার কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন মিস্ত্রি ও শিক্ষার্থীরা। এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বড় আকারের একটি ঘোড়ার কাঠামো দাঁড় করানো হচ্ছে।
এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার এসব কর্মযজ্ঞের দায়িত্বে রয়েছেন চারুকলার ২২ ও ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
এসব কাজকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে- স্ট্রাকচার, পাখির অরিগামি, মুখোশ এবং সরাচিত্র ও পেন্টিং।
স্ট্রাকচার নিয়ে কাজের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের একজন ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সুমিত সেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবার পাঁচটি বড় মোটিভ থাকবে। এসবের মধ্যে রয়েছে ঘোড়া, পাখি ও টেপা পুতুল। বাকি দুটি মোটিভ ঠিক হয়নি। বাকি এই তিনটির কাজ আমরা শুরু করেছি।’
পাখির অরিগামি নিয়ে কাজের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের দুজন হলেন ২২তম ব্যাচের অনন্যা ও ২৩তম ব্যাচের রাসেল।
অনন্যা বলেন, ‘আমরা এখানে বেশ কয়েক রকমের পাখির অরিগামি নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে রয়েছে কবুতর, ছোট রাজা-রানি ও তুহিন পাখি।’
এগুলোর কোনো কোনোটির নাম তাদেরই দেয়া। ছোট ছোট একরকমের অরিগামির নাম দেয়া হয়েছে তুহিন পাখি।
সেই নামের ব্যাখ্যা দিয়ে রাসেল বলেন, ‘এটা আমাদের এক বড় ভাই ডিজাইন করেছেন। তাই তার নামেই এই ছোট পাখিগুলোকে আমরা ডাকছি।’
এছাড়াও তারা তৈরি করছেন হাতপাখা, বানাবেন চরকিসহ আরও কিছু বৈশাখী অনুষঙ্গ।
মুখোশ বানানোর দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের একজন ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম খলিল আসমানী। তিনি বলেন, ‘আপাতত আমরা যেগুলো বানিয়েছে সেগুলো সব অর্ডারি। আপনারা তো জানেনই এসব বিক্রি করে আমাদের শোভাযাত্রার অন্য অনুষঙ্গ বানানোর খরচ ওঠে। বাইরে যেসব পেন্টিং ও সরাচিত্রের কাজ দেখলেন সেগুলো বিক্রির জন্য। এসবের বাইরেও আরও মুখোশ বানানো হবে যেগুলো মঙ্গল শোভাযাত্রায় শোভা পাবে।’
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য করা হয়েছেন- ‘নির্মল কর, মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে’। গানটির এই লাইন থেকে আমরা শুধু প্রথমের ‘তুমি’ শব্দটা বাদ দিয়েছি।”
ফান্ড রেইজিংয়ের জন্য মঙ্গলবার দুপুর থেকে আর্টক্যাম্প শুরু হবে বলেও জানান অধ্যাপক নিসার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি শিল্পী রফিকুন নবী এবং মনিরুল ইসলামসহ সিনিয়র শিল্পীরা এই ক্যাম্পের উদ্বোধন করবেন। এছাড়া স্টুডেন্টরা প্রতিবছর ছবি আঁকাসহ যে কাজগুলো করে, গত বৃহস্পতিবার সেটা শাহাবুদ্দিন ভাই উদ্বোধন (শিল্পী শাহাবুদ্দিন) করে দিয়ে গেছেন।’
এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে শুরু না হয়ে টিএসসির সামনে থেকে শুরু হবে বলে জানান নিসার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এবারও শোভাযাত্রা সকাল ৯টাতেই শুরু হবে। তবে শোভাযাত্রা শুরুর স্থানটি পরিবর্তন হয়েছে। মেট্রোরেলের কাজ চলার কারণে যেহেতু চারুকলার সামনের রাস্তা সংকুচিত হয়ে আছে, তাই টিএসসি থেকে শুরু হয়ে শোভাযাত্রাটি উপাচার্যের বাসভবন মোড়টা ঘুরবে।’
উদযাপনে বাড়তি সতর্কতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এদিকে বাংলা নববর্ষ-১৪২৯ সুষ্ঠুভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ এবং মেট্রোরেলের চলমান উন্নয়ন কাজের জন্য চলাচলের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে আনন্দময় পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নববর্ষ উদযাপনের জন্য উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নববর্ষ সুষ্ঠুভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতির বক্তব্যে উপাচার্য এই আহ্বান জানান।
সভা-পরবর্তী সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের কারণে চলাচলের পথ সরু থাকায় এবছর মঙ্গল শোভাযাত্রা টিএসসি সড়কদ্বীপ থেকে বের করা হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা স্মৃতি চিরন্তন হয়ে পুনরায় টিএসসিতে গিয়ে শেষ হবে।
পহেলা বৈশাখে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা এবং ব্যাগ বহন করা যাবে না। তবে চারুকলা অনুষদের প্রস্তুত করা মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
ক্যাম্পাসে নববর্ষের দিন সব ধরনের অনুষ্ঠান বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে। সন্ধ্যা ৭টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবে না।