বালুভর্তি জিওটিউব ও জিওব্যাগ দিয়ে কুয়াকাটা সৈকতকে বালুক্ষয় থেকে রক্ষায় কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবারের কাজটি যাতে গত বছরের চেয়ে বেশি টেকসই হয়, সে ব্যাপারে জোর দেওয়া হচ্ছে।
‘সৈকত রক্ষায় পরীক্ষামূলক প্রতিরক্ষা কাজ’-এর আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে কাজটি শেষ করতে পারলে সৈকতের উচ্চতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড অস্থায়ীভাবে চালানো এই কার্যক্রমকে সফল দাবী করলেও জনপ্রতিনিধিরা চান সৈকত রক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা।
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে বালুক্ষয়ে বিলীন হয় পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা। গত কয়েক বছরে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সৈকতটির প্রশস্ততা কমে গিয়ে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। পর্যটকসহ স্থানীয়দের বিভিন্ন দাবী ও আন্দোলন-সংগ্রামে প্রতি বছর সৈকত রক্ষার অস্থায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়। এবারও তাই হচ্ছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, গত তিন বছর ধরে তাদের এই অস্থায়ী প্রকল্পে সৈকতের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে বালুক্ষয় রোধসহ ভাঙ্গন অনেকাংশে কমেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত মার্চ মাসে শুরু হওয়া এ কাজ শেষ হবে জুনে। এ জন্য ১৪ হাজার ৩৮৪টি জিও ব্যাগ ও ১২৯টি জিওটিউব ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকার বিজে টেক্সটাইল থেকে উন্নত মানের জিওটিউব ও ব্যাগ কেনা হয়েছে। এ কাজটি করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে কে এন্টারপ্রাইজ। ইতোমধ্যে পুরো প্রকল্পের প্রায় ৪৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, সৈকতের জিরো পয়েন্টের পূর্ব পাশে ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক চাঁদপুর থেকে আনা পাকশি বালু দিয়ে জিওটিউব ও জিওব্যাগ তৈরির কাজে ব্যস্ত। জিরো পয়েন্টের পশ্চিম দিকে ইতিমধ্যে সৈকতের তীরভূমি থেকে ১০০ মিটার দূরত্বে জিওটিউব ও জিওব্যাগগুলো ফেলা হয়েছে।
কাজের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত পটুয়াখালীর কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী সৈয়দ আতিকুর রহমান তুহিন জানান, ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকার এ প্রকল্পে তীর থেকে ১০০ মিটার দূরত্বে এবং সৈকতের জিরো পয়েন্টের দুই পাশে দুই কিলোমিটার এলাকায় বসানো হচ্ছে জিওটিউব এবং জিওব্যগ।
তিনি জানান, এসব ব্যাগ ও টিউব যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন। পাশাপাশি কাজের গুণগত মান অক্ষুন্ন রাখতে ঢাকা থেকে টাস্ক ফোর্সের একাধিক সদস্য ও স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
সৈকতে পাওয়া যায় কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ হোসেনকে। তিনি জানান, দুই বছর ধরে একই পদ্ধতিতে কাজ করা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবারের কাজ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চলছে। ওই সময় কাজটি করা হয়েছিল বর্ষার সময়, যে কারণে কাজটি টেকসই হয়নি। এ ছাড়া আগেরবার স্থানীয়ভাবে বালু সংগ্রহ করা হয়েছিল। এবার কাজের জন্য চাঁদপুর থেকে বালু এনে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি জানান, এবার কাজ বর্ষা মৌসুমের বেশ আগেই শুরু করা হয়েছে এবং নির্ধারিত সময়ের অন্তত দুই মাস আগে এটি শেষ করা সম্ভব হবে। এর ফলে সৈকতের উচ্চতা গত দুই বছরের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পাবে।
আরিফ হোসেন বলেন, নন জিওটিউব বা জিওটিউব কোনোটিই স্থায়ী সমাধান নয়। তবে সাময়িকভাবে তা কার্যকর। এই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহারে বালুক্ষয় ও ভাঙ্গন কমে সৈকত অনেকটা দীর্ঘ হচ্ছে এবং সৈকতের উচ্চতা বাড়ছে। তবে স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। সেখান থেকে একটি প্রকল্প পাস হওয়ার কথা।’
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী ও টাস্কফোর্স সদস্য সুদীপ্ত কুমার বলেন, ‘প্রথমে আমরা নিজস্ব উপায়ে ব্যাগ ও টিউব পরীক্ষা করি। তারপর মেশিনের মাধ্যমে বালুর মানদণ্ড যাচাই করা হয়। সব কিছু ওকে হলেই তারপর টিউব আর ব্যাগে বালু ভরা হয়। এখন পর্যন্ত বালু আর টিউব ব্যবহারে কোনো ধরনের ত্রুটি পাওয়া যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘এটি পর্যটন এলাকা হওয়ায় স্বাভাবিক কারণে প্রশাসন থেকে শুরু করে সব দপ্তরের নজর থাকে এ কাজে। আর সে কারণে আমরাও সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছি।’
এসব ব্যাগ ও টিউব দেখে খুশি পর্যটকসহ স্থানীয়রা। সাতক্ষীরা থেকে ঘুরতে আসা মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এটি আসলেই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কারণ সাগরের ঢেউ তীরে এসে প্রথম যে বাধাটা পাবে সেটি এই টিউবে। যার ফলে ঢেউয়ের চোট বেশি থাকবে না।’
স্থানীয় ভূইয়া মার্কেটের সভাপতি নিজাম হাওলাদার বলেন, ‘আমরা আগেও জিওটিউব বা জিওব্যাগের ব্যবহার দেখেছি। কিন্তু সেই সময় যারা কাজ করেছে, তারা আশেপাশ থেকে বালু সংগ্রহ করে ব্যগের মধ্যে ব্যবহার করত। এবার আমরা দেখছি বাহির থেকে মোটা দানার বালু এনে টিউবের মধ্যে ভরা হচ্ছে। এটা অনেক টেকসই হবে বলে মনে হয়।’
নিজাম হাওলাদার বলেন, ‘গত দুই বছরে সৈকত আমাদের দৃষ্টিতে অনেক উঁচু হয়েছে। এবার আরো উচু হবে। তবে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভালো হয়।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে কে এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী কবির হোসেন জানান, ‘কার্যাদেশে লোকাল বালু ব্যবহারের কথা উল্লেখ থাকলেও এ অঞ্চলে যেহেতু মোটা দানার বালু পাওয়া যায় না, তাই আমাকে চাঁদপুর থেকে মোটা দানার পাকশি বালু এনে এ কাজ করতে হচ্ছে। সৈকতে যেহেতু হাজারও পর্যটক আসে, সে কারণে এখানে লুকোচুরির কোনো সুযোগ নাই। তা ছাড়া আমি যেহেতু এই অঞ্চলের ছেলে, সেহেতু চেষ্টা করি শতভাগ সঠিকভাবে কাজটি করার।’
তিনি জানান, এখানে প্রতিদিন পানি উন্নয়ন বোর্ড, টাস্ক ফোর্সের সদস্য এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, টুরিস্ট পুলিশসহ তার লোকজন তদারকি করেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজও সময়ের মধ্যেই করার চেষ্টা করা হবে বলে জানান তিনি।
এর আগে ২০১৯ সালে কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্টসংলগ্ন দুই দিকে ১ হাজার ৫৬০ মিটার তীরভূমির ভাঙন রোধ করার জন্য একইভাবে বালুভর্তি জিওটিউব ও জিওব্যাগ ফেলা হয়েছিল। তখন পূর্ব দিকে ৫৬০ মিটার ও পশ্চিম দিকে ১ হাজার মিটার এলাকা সুরক্ষা করা হয়। ওই সময় ৬৪টি জিওটিউব ও ৮ হাজার জিওব্যাগ ফেলা হয়। এ কাজে তখন ব্যয় হয় ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
এরপর ২০২১ সালে বালুক্ষয় থেকে সৈকত রক্ষায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল ওভেন জিওটিউব। পরীক্ষামূলকভাবে তা বসানো হয়েছিল কুয়াকাটা সৈকতের দেড় কিলোমিটার এলাকায়। ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানি করা এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় ওই প্রকল্পটি বাদ দিয়ে এ বছর দেশে তৈরি জিওটিউব ও জিওব্যগ দিয়ে কাজ করা হচ্ছে।