রমজানে পুঁজিবাজারে বড় বিনিয়োগের ঘোষণার প্রভাব অন্তত প্রথম দিনের লেনদেনে দেখা যায়নি। বরং রোজার আগের শেষ কর্মদিবসের তুলনায় লেনদেন কমেছে পৌনে ৩০০ কোটি টাকা। কমেছে বেশির ভাগ শেয়ারের দর, তবে বড় মূলধনি কিছু কোম্পানির দরে উত্থানের কারণে সূচকে যোগ হয়েছে পয়েন্ট।
রমজানে নতুন সময়সূচি অনুযায়ী লেনদেন চলেছে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। এমনিতে লেনদেন হয় বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। অর্থাৎ এই মাসে আধা ঘণ্টা কম চলবে শেয়ার কেনাবেচা।
রোববার প্রথম ১২ মিনিটেই সূচক আগের দিনের চেয়ে ৩৭ পয়েন্ট বেড়ে যায়। সে সময় বেশির ভাগ শেয়ারের দরই বেড়ে লেনদেন হতে থাকে।
গত বুধবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে জানানো হয়, রোজায় প্রতিটি ডিলার অ্যাকাউন্টে রমজান মাসে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করবে। এতে শেয়ারবাজারে নতুন ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে।
এ ছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিওর মাধ্যমে রমজান মাসে নতুন করে ২০০-৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সমিতি বিএমবিএর সভাপতি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।
এই ঘোষণার পরদিন বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজারে লেনদেন এক হাজার ১০০ কোটি টাকা ছাড়ায় যা ছিল গত ১৬ ফেব্রুয়ারির পর সর্বোচ্চ।
তবে যেদিন থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা, সেদিন লেনদেন হয় ৮৩৬ কোটি ৬২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, যা গত ২৪ মার্চের পর সর্বনিম্ন। সেদিন হাতবদল হয়েছিল ৮২৯ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি রোজারিও নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজকের ট্রেড দিয়েই বাজার ভালো বা খারাপ বলা যাবে না। ব্রোকারগুলোতে দেখবেন, রমজানের কারণে অনেক বিনিয়োগকারীই আসেননি। এছাড়া ট্রেডের সময়ও কমে গেছে। যার কারণে লেনদেন কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।’
রমজানে প্রত্যেক ব্রোকারের এক কোটি টাকা বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো সবসময়ই বিনিয়োগ করছি, এবং বিনিয়োগ থাকবেই। কিন্তু বাজারে এক শ বা দুই শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাজার ভালো করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ, বড় ফান্ড।
‘তবে আজকে লেনদেন স্বাভাবিকভাবেই কমেছে। একদিন কমবে, একদিন বাড়বে, এটাই বাজারের নিয়ম। বাজারকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে।’
রোজার প্রথম দিন পুঁজিবাজারে লেনদেনের চিত্র
দিন শেষে যত কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে, কমেছে তার দ্বিগুণের বেশি। ১২৯টি কোম্পানি দর বেড়েছে, বিপরীতে কমেছে ১৯৫টির দর। ৫৫টির দর ছিল অপরিবর্তিত।
বেশির ভাগ কোম্পানির দর হারানোর পরও সূচকে পয়েন্ট যোগ হওয়ার কারণ লাফার্জ, রবি, ওয়ালটন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর মতো বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধি।
সবচেয়ে ভালো দিন গেছে আর্থিক খাতে। ২২টির মধ্যে ১৯টি কোম্পানির দর বেড়েছে এক দিনে। একটির দর ছিল অপরিবর্তিত। বিপরীতে কমেছে কেবল দুটির দর।
ব্যাংক খাতে বেড়েছে ১৬টির দর, কমেছে ৯টির, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১৯টির ইউনিট মূল্য, কমেছে তিনটির।
উদ্যোক্তা পরিচালকদেরকে মোট শেয়ারের ৬০ শতাংশ ধারণে এক যুগ আগের করা আইন কার্যকরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ চিঠি দেয়ার দ্বিতীয় কর্মদিবসে এই খাতের প্রায় সব কোম্পানিই দর হারিয়েছে। সাধারণ বিমা খাতে বেড়েছে তিনটির দর, কমেছে ৩৬টির। জীবন বিমা খাতে ৬টির দর বেড়েছে, কমেছেও সমসংখ্যক।
প্রধান অন্য খাতগুলোর মধ্যে বস্ত্র, প্রকৌশল, ওষুধ ও রসায়ন, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি- সব খাতেই বেশির ভাগ কোম্পানি দর হারিয়েছে।
সবচেয়ে বাজে দিন গেছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। এই খাতের ১১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে কেবল একটির, কমেছে ৯টির। একটি দর ধরে রাখতে পারে।
লেনদেনও সবচেয়ে বেশি হয়েছে আর্থিক খাতে। এই খাতে ১৩৮ কোটি টাকা হাতবদল হয়েছে। এর পরের অবস্থানগুলো ছিল বস্ত্র, প্রকৌশল ও সাধারণ বিমা।
সূচক বাড়ল যাদের কারণে
সূচক সবচেয় বেশি ৩.১১ পয়েন্ট বেড়েছে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্টের দর ৪ শতাংশ বাড়ার কারণে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২.৮১ পয়েন্ট সূচকে যোগ করতে পেরেছে রবি। কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ১.৭৯ শতাংশ।
এছাড়া ওয়ালটন ২.৩৮ পয়েন্ট, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানি ২.৩৬ পয়েন্ট, বিকন ফার্মা ১.৮৪ পয়েন্ট, আইপিডিসি ১.৩৬ পয়েন্ট, আইসিবি ১.১৫ পয়েন্ট যোগ করেছে। লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, ব্র্যাক ব্যাংক, বেক্সিমকো ফার্মাও কিছু পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১৭.২২ পয়েন্ট।
বিপরীতে ইউনাইটেড পাওয়ার, রেনাটা, বেক্সিমকো লিমিটেড, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, লিনডে বিডি, ফরচুন সুজ, আল আরাফাহ ব্যাংক, সামিট পাওয়ার, সোনালী পেপার ও আরএকে সিরামিকসের কারণে সূচক কমেছে সবচেয়ে বেশি। তবে দরপতনের হার খুব বেশি না হওয়ায় এই ১০ কোম্পানি সূচক কমাতে পেরেছে ৫.৫ পয়েন্ট।
আর্থিক খাতের রমরমা
টানা দ্বিতীয় দিন দর বৃদ্ধির শীর্ষ স্থানে ছিল জেএমআই হসপিটাল, যার দর বেড়েছে ১০ শতাংশ। ২০ টাকায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি টানা দুই দিন ১০ শতাংশ করে বেড়ে হয়েছে ২৪ টাকা ২০ পয়সা।
শীর্ষ দশে দেখা গেছে আর্থিক খাতের প্রাধান্য, যার মধ্যে আইপিডিসির দর বেড়েছে ৯.৯২ শতাংশ। বৃহস্পতিবার দর ছিল ৪১ টাকা ৩০ পয়সা। দর বাড়ার সুযোগ ছিল ৪ টাকা ১০ পয়সা। এতটাই বেড়ে দর দাঁড়িয়েছে ৪৫ টাকা ৪০ পয়সা।
চার কর্মদিবসে শেয়ারটির দর বাড়ল ১১ টাকা ৪০ পয়সা বা ৩৩.৫২ শতাংশ।
আর্থিক খাতের অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্সের দর ৮.১৬ শতাংশ, বে লিজিংয়ের দর ৭.৪৭ শতাংশ, ইসলামিক ফাইন্যান্সের দর ৬.২২ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের দর ৫.৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে সিএপিএমবিডিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর ৮.৯১ শতাংশ, ইমামবাটনের দর ৭.৫৫ শতাংশ, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলসের দর ৬.৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
শীর্ষ দশের বাইরে ইউনাইটেড, লংকাবাংলা, ফিনিক্স ও মাইডাস ফাইন্যান্সের দর ৪.৭৩ শতাংশ, থেকে ৫.৩১ শতাংশ বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও প্রাইম ফাইন্যান্সের দর বেড়েছে ৩ শতাংশের বেশি।
দর হারানো কোম্পানির ক্রেতাই কম
সবচেয়ে বেশি দর হারানো কোম্পানিগুলোর সবগুলোর শেয়ারদর কমেছে এক দিনে যত কমা সম্ভব ততটাই। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ২ শতাংশের বেশি দর পড়তে পারে না। আর এসব কোম্পানির দর কমেছে এতটাই। তবে শেয়ারদর কমলেও ক্রেতা ছিল না খুব বেশি। এক পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ বিক্রয় আদেশ ছিল, ক্রেতা ছিল না বললেই চলে।
লিনডে বিডি, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্ট, এপেক্স স্পিনিং, ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স, আমরা নেটওয়ার্ক, এটলাস, পেপার প্রসেসিং, বিডি ল্যাম্পস, সোনালী আঁশ, আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের দর দরপতনের নিম্নসীমায় লেনদেন হয়েছে।