উজানের পানির চাপে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালী বাঁধ ভেঙে গেছে।
বাঁধ ভেঙে শনিবার সকাল থেকে পানি ঢুকতে শুরু করেছে হাওরে। এতে ফসলহানির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, ভেঙে যাওয়া বাঁধটি ফসল রক্ষার জন্য করা হয়নি। এটি ভাঙলেও ফসলহানির শঙ্কা নেই। এ বছর সুনামগঞ্জে আগেভাগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে ভারতের মেঘালয়েও। ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ঢলেই শনিবার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালী বাঁধ ভেঙে গেছে।
তাহিরপুরের ১ নম্বর উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও কৃষক সাজিনুর মিয়া বলেন, ‘এবার বাঁধের কাজে অনেক গাফিলতি হয়েছে। নজরখালী বাঁধটি শক্তিশালী করে নির্মাণের জন্য আমি অনেকবার কথা বলেছি।’তিনি বলেন, ‘এই বাঁধ ভাঙার ফলে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকতে থাকলে হাওরের অনেক ফসল তলিয়ে যাবে।’এই বাঁধ দিয়ে পানি ঢোকায় উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের গইনাকড়ি হাওর, এরাইল্লার হাওর, সন্যাসী হাওর, পইল্লার বিল হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন এই জনপ্রতিনিধি।সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ১২০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে তাহিরপুর অংশে চাষ হয়েছে ২৫ হেক্টর জমিতে।হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জে অতিবৃষ্টি ও ঢলের কারণে দেখা দেয় অকালবন্যা। এতে নষ্ট হয় হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। ধান রক্ষায় প্রতি বছর হাওরাঞ্চলে নির্মাণ করা হয় ফসল রক্ষা বাঁধ।ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে শুরু হয় এই বাঁধের কাজ, যা ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা। প্রতি বছরই এই বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।পাউবো কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ১২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২৪ কোটি টাকা।এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালে অকালবন্যায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হাওরের বোরো ফসল।পাউবোর সুনামগঞ্জ জেলা কার্যায়ল সূত্রে জানা গেছে, নজরখালী বাঁধ নির্মাণের জন্য এবার ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় পাউবো।তবে পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, এই বাঁধটি ফসল রক্ষার জন্য নয়, এলাকাবাসীর অনুরোধে বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছিল।পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট (আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি) ঘোষণার পর থেকে এখানে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয় না। মৎস্য অভয়ারণ্য এই হাওরে ধান চাষও হয় না। তবে হাওরের কিছু ভাঙা অংশ ছিল তাই এলাকাবাসীর অনুরোধে বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে এখানে বাঁধ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরেও কৃষকরা এবার বোরো চাষ করেছেন জানিয়ে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান কবির বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে কৃষকরা নিজ উদ্যাগে কিছু ফসল রোপণ করেছেন। তাহিরপুর অংশে মাত্র ২৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। এ ছাড়া যে বাঁধটি ভেঙেছে সেটিও ফসল রক্ষা বাঁধ নয়।’তিনি বলেন, ‘বাঁধ ভাঙার খবরে আমি এলাকায় এসেছি। এদিক দিয়ে পানি প্রবেশ করায় বরং নদীর পানির চাপ কমবে। ফলে অন্য বাঁধগুলো রক্ষা পাবে। তাই কৃষকদের আতঙ্কের কিছু নেই।’২০১৭ সালে বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসলহানির পর গড়ে উঠেছিল ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ বছরও বাঁধের কাজ নিয়ে শুরু থেকেই অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ করে আসছে সংগঠনটি।হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘ফসল রক্ষার জন্য হোক বা হোক, সরকারি অর্থ ব্যয়ে এই বাঁধটি নির্মিত হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই তা ভেঙে যাবে কেন।তিনি বলেন, ‘বাঁধের কাজে গাফিলতির ব্যাপারে এবার আমরা আগে থেকেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম; কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনেনি। এখন বৃষ্টি শুরু হতেই বাঁধ ভেঙে পড়ছে।’