রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় ২০টি মুদি দোকান ঘুরেও দেশি চিনি পাননি মো. হোসেন। নিরুপায় হয়ে চিনির জন্য দেড় কিলোমিটার হেঁটে কারওয়ান বাজার এসেছেন তিনি। সেখানেও কয়েকটি দোকান ঘুরে প্রতি কেজি দেশি চিনি কিনেছেন ৯৫ টাকায়।
‘দেশি চিনির এতো চাহিদা থাকলেও কেন বাজারে পাওয়া যায় না?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি। এমন প্রশ্ন রাজধানীর অনেক বাসিন্দার। চিনির দাম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।
বেশ কিছু দিন ধরে রাজধানীর বাজারে বেশ চড়া চিনির দাম। রমজান মাসকে সামনে রেখে দাম আরও বেড়েছে। বিভিন্ন মহল্লায় দেশি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, আর আমদানি করা সাদা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ বলছে, গত বছরের তুলনায় চিনির কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। গত বছর মার্চের শেষ দিকে চিনির কেজি ছিল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা।
দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে মাত্র ৫০ হাজার টনের মতো। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। দেশি চিনির উৎপাদন কমায় আমদানিকারকরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে দিনে দিনে বাড়ছে এ পণ্যটির দাম।
চিনির ক্রেতা হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবাই বলে, সাদা চিনিতে নাকি বিষ। তাই সাদা চিনির পরিবর্তে লাল চিনি ব্যবহার করছি। কিন্তু দোকানে দোকানে ঘুরেও এই চিনি পাওয়া যায় না। বাজারে তো সব সাদা চিনি। চিনি ছাড়া তো চলা যায় না। ভালো চিনি না পেলেও মানুষ চিনি খাবে। বেশি দামেই খাবে।
‘আগে মহল্লার এক দোকান থেকেই দেশি চিনি নিতাম, কিন্তু এবার সে আনতে পারেনি। তাই এক কেজি চিনির জন্য আমাকে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হবে, না হলে ৬০ টাকা রিকশা ভাড়া গুণতে হবে। বারবার তো আসা যাবে না তাই তিন কেজিই কিনেছি।’
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী শাহ পরান এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহ পরান বলেন, ‘মহল্লার তুলনায় কারওয়ান বাজারে দাম কিছুটা শস্তা। সাদা চিনি আমাদেরই কেনা পড়ে ৭৩ টাকা, আমরা ৭৫-৭৬ টাকায় বিক্রি করি। লাল চিনি আমাদের কেনা পড়ে ৯০ টাকার মতো, বিক্রি করি ৯৫ টাকায়। তবে এ চিনি পাওয়া যায় না।’
তন্না এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা তারেক হোসেন বলেন, ‘দেশি চিনির সরবরাহ এবং দাম ঠিক নেই। কোনো দিন পাওয়া যায়, কোনো দিন যায় না। আবার কোনো দিন কেনা পড়ে ৮৮ টাকা, কোনোদিন ৯২ টাকা। এখন ৮৮ টাকা কেনা ৯২ থেকে ৯৫ টাকা বেচা। তবে আমদানি করা সাদা চিনির কেজি ৭৭-৭৮ টাকা।’
এছাড়া বাজারে বেশ কিছু কোম্পানি প্যাকেট চিনি সরবরাহ করে। এর মধ্যে কেউ কেউ আখের চিনিও প্যাকেটে বিক্রি করে। তীর, ফ্রেশসহ সব ব্র্যান্ডের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৮৬ টাকায়।
গত ৯ সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে চিনির দাম ঠিক করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারস অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি কেজি খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৭৪ ও প্যাকেটজাত চিনি ৭৫ টাকা নির্ধারিত হয়। তবে ছয় মাসেও তা কার্যকর হয়নি। বরং বাজারে নির্ধারিত দরের চেয়ে সাদা চিনিতে ৪-৬ টাকা, সাদা প্যাকেটে ১০ টাকা এবং দেশি চিনি ২৫ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
দেশি চিনি উৎপাদন তলানিতে, বাড়ছে আমদানি
গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশি আখের চাহিদা বেশ বেড়েছে। তবে উল্টো পথে রেয়েছে চিনির উৎপাদন। চাহিদা তু্ঙ্গে থাকলেও প্রতি বছরই কমছে দেশি চিনি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও দেশের চিনিকলগুলোতে ১ লাখ ২৮ হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল। গত বছর তা এসে ঠেকে ৪৮ হাজার ১৩৩ টনে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও তলানিতে নেমেছে উৎপাদন, মাত্র ২৪ হাজার ৯শ টন, যা এ যাবতকালের সর্বনিম্ন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে গত দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। রমজান মাসে এর চাহিদা ৩ লাখ টন। প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার টনরে মতো চিনি আমদানি বাড়ছে। সর্বশেষ বছরে আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন। তাই বাজারে কোনো সরবরাহ সংকট নেই, বরং বাড়তি যোগান রয়েছে।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চিনি ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাইকারি বাাজরে এখন চিনির কেজি ৭২ টাকা। খুচরা দোকানে তা সর্বোচ্চ ৭৪-৭৫ টাকা হওয়া উচিৎ। যদিও রমজান মাসে সাধারণত চিনির চাহিদা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে। দেশে এখন চিনির কোনো ঘাটতি নেই। আশা রাখি চিনির কোনো সঙ্কট হবে না। দামও আর বাড়বে না, বরং দাম কমা উচিত।’