বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লোকসানে ধুঁকছে ফরিদপুর সুগার মিল

  •    
  • ১ এপ্রিল, ২০২২ ১০:০৬

মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ খবির উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘চিনিকলটি ৪৬টি মাড়াই মৌসুমের মধ্যে মাত্র ১৩টিতে লাভ করে। বাকিগুলোতে লোকসান হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৩৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান রয়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ মৌসুমে লোকসানের মূল কারণ হিসেবে এটিসহ মোট ছয়টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধের কথা বলা হয়। এতে কৃষকদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। ফলে আখ সংকট দেখা দেয়।’

লোকসানের বোঝায় ধুঁকছে ফরিদপুর সুগার মিলস লিমিটেড। ১৯৭৬ সালে উৎপাদনে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানটি মোট ৪৬টি মাড়াই মৌসুমের মধ্যে মাত্র ১৩টি মৌসুম লাভের মুখ দেখেছে। বাকি ৩৩টি মাড়াই মৌসুম কেবলই লোকসান গুনতে হয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা পায় ফরিদপুর সুগার মিলস। মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নে ১২৯ দশমিক ৯৭ একর জমির ওপর কারখানাটি স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠার দুবছর পর ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যায়।

ফরিদপুর সুগার মিলস লিমিটেড বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান।

ফরিদপুর জেলায় একমাত্র ভারী কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান এই সুগার মিল এখন এক অবহেলিত প্রতিষ্ঠানের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ মেশিন, আখের ভালো জাতের অভাব, শুধু চিনি উৎপাদনে নির্ভরশীলতা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ডুবতে বসেছে মিলটি।

কারখানাটি ৩৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসানে রয়েছে। মিলের অধিকাংশ যন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে গেছে। একইসঙ্গে সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

ফরিদপুর চিনিকল লিমিটেড দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেশের অন্যতম প্রধান এই চিনিকলে চিনি ছাড়াও জৈব সার, চিটাগুড় ও মণ্ড উৎপাদন করা হয়। মিলটির আখ মাড়াই ক্ষমতা প্রতিদিন এক হাজার ১৬ টন। তবে আখের অভাবে মিলটি বছরে সাত্র এক মাস ১০ দিন চালু রাখা সম্ভব হয়। মিলটি এ পর্যন্ত ৪৫ মাড়াই মৌসুমের মধ্যে লাভের মুখ দেখেছে ১৩ মৌসুম। লোকসান গুনতে হয়েছে ৩৩ মৌসুমে।

মিলটিতে সবশেষ আখ মাড়াই শুরু হয় ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এটি ৪৬তম মৌসুমের আখ মাড়াই। ৪০ কার্যদিবসে ৪১ হাজার টন আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে দুই হাজার ৯০০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ আখ মাড়াই মৌসুমে মিলটি ১০৩ কার্যদিবসে এক লাখ আট হাজার ৪২৩ টন আখ মাড়াই করে আট হাজার ১৩১ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছিল শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ। সেই মৌসুমে মিলটিকে ৭০ কোটি ৩৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়।

২০১৯-২০ অর্থবছর ৪২৮ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় ছিল মিলটির। ওই মৌসুমে ১০ হাজার একর জমিতে আখ রোপণ করা হয়। ৭৭ কার্যদিবসে মোট ৭৮ হাজার টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ধরা হয় শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ।

সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চিনিকলের প্রায় ৩৪৬ দশমিক ৬০ টন চিনি অবিক্রীত অবস্থায় গুদামে পড়ে আছে। চিনিকলটির নিজস্ব উৎপাদিত চিনির পাইকারি বিক্রি মূল্য কেজিপ্রতি ৭৪ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়।

চলতি বছর চার হাজার ৪৩৩ চাষির মাঝে তিন কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে মিল কর্তৃপক্ষ।

মিলটি মাড়াই মৌসুমজুড়ে চিনি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত আখের সরবরাহ পায় না। তাই বছরের একটা বড় সময়জুড়ে উৎপাদন বন্ধ থাকে। অথচ বাজারজাতকরণ, বিতরণ, যন্ত্রাংশ মেরামত, লেনদেন ও ব্যবস্থাপনার কাজ বছর জুড়েই চলে। কিন্তু পণ্য বহুমুখীকরণ (অ্যালকোহল, স্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক, বায়োগ্যাস, জৈবসার, বর্জ্য ও ছোবড়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন) না করায় সরাসরি উৎপাদনে জড়িত শ্রমিক-কর্মচারীরা পুরো বছর কাজের সুযোগ পান না। অথচ বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন খরচ বহন করতে হয় মিল কর্তৃপক্ষকে।

পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণ

চিনিকলে আখের সরবরাহ ঘাটতির নেপথ্যে বেশকিছু কারণ তুলে ধরেছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষকদের অভিযোগ, খরচের তুলনায় আখের দাম পাওয়া যায় না। চিনিকলে সময়মতো আখ বিক্রি করা যায় না। আবার বিক্রি করলেও সময়মতো অর্থ পাওয়া যায় না। ফলে তারা আখের বদলে ধান বা সবজি চাষে ঝুঁকেছেন। আবার যারা আখ চাষ করছেন তারাও চিনিকলের বদলে গুড় উৎপাদকের কাছে আখ বিক্রি করছেন। তাছাড়া ভালো মানের আখ উৎপাদনে যথেষ্ট প্রণোদনা নেই। অর্থাৎ সব গ্রেডের আখের দাম একই। এতে মান বাড়ানো নিয়ে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ দেখা যায় না।

কৃষক ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমরা আগে আখ চাষ করতাম। কিন্তু এখন আর আখ চাষ করে লাভ হয় না। আখের জাতও ভালো নয়। সাধারণ মানুষের অত্যাচারও আছে। তাই আখ চাষ করা বাদ দিয়েছি। তবে আখ চাষে লাভ হলে এবং সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা আবার আখ চাষ করব।’

সুগার মিলের শ্রমজীবী ইউনিয়নের সাবেক সহ-সভাপতি ও জুনিয়র কার্বাইন অপারেটর (যান্ত্রিক বিভাগ) মেহেরাব হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সুগার মিলটি জেলার ঐতিহ্য। এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবন-মান, জীবিকা ও ভাগ্য জড়িয়ে আছে। মিলটি বাঁচিয়ে রাখতে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি বায়োপ্রডাক্ট বাড়াতে হবে।’

মিলটি লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই বলে দাবি করেন শ্রমজীবী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজল বসু। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মিলটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৯০০। মোট ৪ হাজার ৮৯২ জন আখ চাষি রয়েছেন চিনিকলের আওতায়। কারখানাটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ জরুরি।’

মিলটির (যান্ত্রিক বিভাগের দায়িত্বে) উপ-ব্যবস্থাপক (যন্ত্র কৌশল) মো. রাজু আহম্মেদ বলেন, ‘১৯৭৬ সালে মিলটিতে মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয়। সে হিসাবে এর বয়স ৪৬ বছর। মেশিনপত্র পুরনো। মিলটি বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। তবে মেশিনের আধুনিকায়ন করে কারখানা নতুনভাবে সাজালে লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’

মিলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) মোহাম্মদ আনিস উজ্জামান বলেন, ‘এটি একটি সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। এই মিল জোন এলাকায় ৩৬ হাজার ৫০০ একর জমি আছে। সেখানে আখ চায় করা যায়। বিগত বছরগুলোতে এখান থেকে ১৩ হাজার একর জমিতে আখ চাষ হতো। কিন্তু চাষিদের লোকসানের কারণে আখের আবাদ কমে গেছে। সবশেষ মৌসুমে মাত্র ৩ হাজার ১১৪ একর জমিতে আখের চাষ হয়েছে।’

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ খবির উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘চিনিকলটি ৪৬টি মাড়াই মৌসুমের মধ্যে মাত্র ১৩টিতে লাভ করে। বাকিগুলোতে লোকসান হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৩৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান রয়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ মৌসুমে লোকসানের মূল কারণ হিসেবে এটিসহ মোট ছয়টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধের কথা বলা হয়। এই খবর শুনে কৃষকদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। অনেক আখচাষি আখ ভেঙে ফেলেন। অনেকে হতাশায় পড়েন। ফলে আখ সংকট দেখা দেয়।

এ বিভাগের আরো খবর