মাগুরা সদর উপজেলার হাজরাপুর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মুন্সী সোহাগ হোসেন। জন্মের পর থেকেই কঠিন আর্থিক পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠেছেন। পরিবারের হাল ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতে চালিয়েছেন ভ্যান।
তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক বৃত্তি তার জীবন পাল্টে দিয়েছে। ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে লেখাপড়া শেষে ফিরেছেন দেশে। তিনি এখন আইটি খাতে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছেন।
বৃহস্পতিবার নিজ বাড়িতে বসে নিজের জীবনের গল্প শোনালেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।
সোহাগ বলেন, ‘ভ্যান চালিয়ে নিজের খাতা কিনেছি। আমার বাবা একজন দিনমজুর ছিলেন। দারিদ্র্য থাকলেও আমার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল পড়ালেখার প্রতি। প্রধানমন্ত্রীর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কথাটি আমাকে খুব উৎসাহিত করত। নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছি।’
নদীভাঙনের শিকার সোহাগের পরিবার ১৯৮৬ সালের আগেই আসেন মাগুরায়। পরে তার পরিবারের ঠাঁই হয় গুচ্ছগ্রামে।
সোহাগ বলেন, ‘নানা ধরনের সমস্যা ছিল। আজকে ওখানে কালকে ওখানে। আমার বাবা যখন এখানে এলেন, তখন আমরা একটা স্থায়ী ঠিকানা পাই।’
পরিবারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। তাদের মধ্যে আমি শুধু লেখাপড়ার সুযোগ পাইছি। বাকি দুই ভাই ভাঙারির ব্যবসা করেন।’
সোহাগ বলেন, ‘আমি সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই। ২০০৯ সালে এসএসসি পাস করি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। মাগুরা আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। আমার পারিপার্শ্বিকতার কারণে অনেক কটূক্তি শুনতে হতো। ভালো পরিবারের যারা ছিল তাদের চেয়ে যখন আমি রেজাল্ট ভালো করি, তখন অনেকেই সমালোচনা করত। কেউ আবার উৎসাহ দিত।’
মা ছখিনা বেগমের সঙ্গে মুন্সী সোহাগ হোসেন। ছবি: নিউজবাংলা
উচ্চশিক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে আমার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দেয়ার জন্য যে খরচ তা আমার পক্ষে দেয়া কঠিন ছিল। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে ভর্তি হই।
‘পরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আইসিসিআর স্কলারশিপ পেয়ে ২০১৬ সালে ভারতে যাই। গুজরাট প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাঙ্ক্ষিত ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি বিষয়টি পাই। ২০২০ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমি দেশে ফিরে আসি।’
দেশে ফিরে মনে হয়েছে, চাকরি না করে নিজেই কিছু একটা করবেন। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছেন।
এই সাহস করার পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বারবার করা এক আহ্বান জুগিয়েছে প্রেরণা।
সোহাগ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ কথাটি আমাকে খুব উৎসাহিত করত। ডিজিটাল বাংলাদেশের বেনিফিট কাজে লাগানোর জন্য আমি ঢাকা থেকে বাড়িতে আসি।’
“প্রযুক্তি দিয়ে চারপাশের মানুষের সমস্যা সমাধানে আমি একটা প্রতিষ্ঠান করি, যার নাম ‘পল্লিটেকস’। পরে মাগুরা সদর উপজেলা প্রশাসনকে একটি বিগ ডাটা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার করে দেই। এর উদ্দেশ্য, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সমস্যাগুলো যেন তারা (প্রশাসন) দেখতে পারে এবং সেবা পৌঁছাতে পারে।”
নিজের এই প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পর্কে সোহাগ জানান, তারা মূলত নানা সফটওয়্যার তৈরি ও উন্নয়নের কাজ করেন। এতে মাসে কখনও ৪০ হাজার, কখনও এক লাখ টাকা আয় হয়।
নিজের আয়ের পাশাপাশি পাঁচজনের চাকরির ব্যবস্থাও করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে তিনজন ইঞ্জিনিয়ার ও দুজন মার্কেটিং অফিসার কাজ করেন।
এই তরুণের মা ছখিনা বেগম বলেন, ‘বাড়ি ছিল না। কষ্ট করেছি। এমনও সময় গেছে ছেলে বলেছে, খাতা লাগবে, কলম লাগবে, পরীক্ষার ফি লাগবে। দিতে পারি নাই। এহন ছেলে ভারতে লেখাপড়া শেষ করে দেশে আসছে। সে এখন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।’
ছখিনা বেগম আরও বলেন, ‘টুকটাক যা আয় করে নিজে চলে। আরও পাঁচটা ছেলে চালায়। যা টাকা পায়, আনি আমার হাতে দেয়।’
মাগুরা জেলার জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর যে ভিশন ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ; সোহাগ সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়েছেন। আইটির আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং কাজে লাগিয়ে তিনি আইটি উদ্যোক্তা হয়েছেন।’