খুলনা মহানগরীতে অভ্যন্তরীণ গণপরিবহন চলাচল বন্ধ চার বছর ধরে। শহরে গন্তব্যে পৌঁছাতে নগরীবাসী নির্ভর করে তিন চাকার বাহনের ওপর। এতে তাদের পরিবহন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। সেই সঙ্গে বেড়েছে যানজটে ভোগান্তি।
দেশ স্বাধীনের পর ৬০টি বাস নিয়ে খুলনা শহরে ‘নগর পরিবহন’ সেবা চালু হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই গাড়িগুলো টানা সেবা দেয়। এরপর সেগুলো চলাচলে অনুপোযোগী হতে শুরু করে। তখন স্থানীয়রা এর নাম দেয় ‘মুড়ির টিন’।
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের মধ্যে ৫৫টি বাসই চলাচলের যোগ্যতা হারায়। এর পরের বছরই শহরে গণপরিবহন সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৬ সালে বিআরটিসির পাঁচটি দোতলা বাস চালু করলে গণপরিবহন বন্ধের ওই সিদ্ধান্ত এড়ানো যায়নি।
২০১৮ সালে শহরের নগর পরিবহন সেবা বন্ধ হওয়ায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। একই বছরে অনুষ্ঠিত হয় খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক নির্বাচনি ইশতেহারে ‘নগর পরিবহন’ পুনরায় চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পান। তবে তিনি চার বছর ধরে মেয়রের দায়িত্ব পালন করলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
বেড়েছে পরিবহন খরচ
‘নগর পরিবহন’ বন্ধের পর ২০১৮ সাল থেকে খুলনা শহরের রূপসা-ফুলতলা রুটে চলছে তিন চাকার যান (মাহিন্দ্রা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা)। এ যানে যাত্রীপ্রতি ভাড়া আদায় করা হয় ৬০ টাকা। অথচ বন্ধ হওয়ার আগে নগর পরিবহনে এ রুটে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ছিল মাত্র ২৫ টাকা। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হতো অর্ধেক ভাড়া।
খুলনা শহরের দৌলতপুরে অবস্থিত সরকারি বিএল কলেজ। শহরের রূপসা থেকে এ কলেজের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারেরও বেশি। প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে কলেজে যান।
তাদের একজন আরাফাত হোসেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খুলনার শিববাড়ী থেকে দৌলতপুর পর্যন্ত মাহেন্দ্রায় ভাড়া নেয়া হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এ হিসাবে আমার কলেজে যেতে প্রতি মাসে খরচ হয় দেড় হাজার টাকারও বেশি।
তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি নগর পরিবহনে এই রুটে ভাড়া ছিল ১০ টাকা। আর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেয়া হতো। ফলে নগর পরিবহন থাকলে প্রতি মাসে আমার পরিবহন খচর হতো ৩০০ টাকারও কম।
খুলনা মহানগরীতে একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি পদে চাকরি করেন আহমেদ আলী। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন আমাকে শহরের বিভিন্ন ফার্মেসি, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমি মোটরসাইকেল ব্যবহার করি। তবে অনেক সময় যানজটের কারণে বিভিন্ন স্থানে যেতে দেরি হয়।
‘আমাদের প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ওষুধ বিক্রি করতে হয়। না হলে পর্যাপ্ত বেতন পাওয়া যায় না। যানজটের ফলে অনেক সময় আমি বেশিসংখ্যক ফার্মেসি বা হাসপাতালে যেতে পারি না।’
শহরে বাড়ছে যানজট
সরকারি হিসাবে খুলনা শহরে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বাসবাস করে। এ বিপুলসংখ্যক মানুষ চলাচলের জন্য তিন চাকার যান (মাহেন্দ্রা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক ও রিকশা) ব্যবহার করে। কেসিসির মতে, শহরে প্রায় ২০ হাজার রিকশা, ১০ হাজার ইজিবাইকসহ অন্যান্য যান চলাচল করে। তবে বাস্তবে সেই সংখ্যা আরও বেশি।
এসব ছোট যান ও অদক্ষ চালকের কারণে শহরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট।সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর শিববাড়ী, ময়লাপোতা মোড়, শামসুর রহমান রোড, কমার্স কলেজ মোড়, সাউথ সেন্ট্রাল রোড, সিমেট্রি রোড, পাওয়ার হাউস, ফেরিঘাট, ডাকবাংলো, শান্তিধাম, স্যার ইকবাল রোড, পিটিআই মোড়, টুটপাড়া কবরখানা মোড়, সাতরাস্তার মোড়, ফুলমার্কেট, ক্লে রোড, মহারাজ চত্বর, কদমতলা স্টেশন রোড, কালীবাড়ি রোড, গল্লামারী মোড়, দৌলতপুর বাসস্ট্যান্ডসহ ব্যস্ততম সড়কে প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকে।খুলনা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি)। কেএমপির ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) তাজুল ইসলাম বলেন, ‘খুলনা শহরে কিছুটা যানজট বেড়েছে। এর মূল কারণ হলো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। বর্তমানে শহরের বেশ কিছু স্থানে রাস্তা বা ড্রেনের কাজ চলছে। এ কাজগুলো হয়ে গেলে যানজট অনেকটা কমে যাবে।’
‘নগর পরিবহন’ চায় নগরবাসী
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) খুলনা মহানগরের সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বলেন, ‘খুলনায় শহরের জন্য অবিলম্বে কমপক্ষে ২০-২৫টি গণপরিবহন চালু করা দরকার। এতে নগরবাসীর পরিবহন খরচও কমবে, একই সঙ্গে যানজটও কমে যাবে।’
খুলনা মোটর বাস মালিক সমিতির সভাপতি শিবলি বিশ্বাস বলেন, ‘মাহেন্দ্রা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার কারণে নগর পরিবহন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাদের একটি শক্ত রাজনৈতিক সিন্ডিকেট রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান মেয়র নির্বাচনের সময়ে আমাদের শহরের ‘নগর পরিবহন’ চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি।
‘বাস মালিক সমিতির সঙ্গে সমন্বয় করে নগর পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে সহজে নগরবাসীকে পরিবহন সেবা দিতে পারবে।’
যা বলছেন কেসিসি মেয়র
কেসিসির মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খুলনা শহরের বেশ কয়েকটি রাস্তার অবস্থা ভালো না। আমরা প্রথমত শহরের রাস্তাগুলো মেরামতের জন্য কাজ করছি।
‘এ ছাড়া বর্ষাকালে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পানিতে ডুবে যায়। আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি।’
তবে নগর পরিবহন সেবা চালুর কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে কেসিসির নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।