ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী আচরণের অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে সরকারের কাছে সহজে ব্যবসা করারও সুযোগ চেয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনা: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমানের সভাপতিত্বে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ নেতারাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এসময় এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘সারাবিশ্বে গড় কর্পোরেট করের হার ২৩ শতাংশ, কিন্তু দেশে কর্পোরেট করের হার ৩০ শতাংশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে অন্যান্য দেশগুলোর ট্যাক্স কমিয়ে আনছে কিন্তু আমাদের এখানে সে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গুটিকয়েক চোরের কারণে সব ব্যবসায়ীকে চোর হিসাবে দেখা হয়। তাদেরকে নানাভাবে নানা কারণে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও বেশি ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে।’
শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ করে সরকার ভ্যাট যুক্ত করে দিল, কিন্তু অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো তো এখনও রেডি হয়নি। কারো সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ করেই একটা পণ্যের উপর ট্যাক্স ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করে দেয়া হয়। এই যে ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে এতে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এনবিআরের অথোরিটারিয়ান (কর্তৃত্ববাদী) মনোভাব পরিহার করতে হবে। না হলে সরকারের ব্যবসা-বান্ধব যে মনোভাব, সেটা নষ্ট হবে। যিনি করের হার ঠিক করবেন, তিনি কর তুলবেন এটা কীভাবে হয়। কর নির্ধারণ ও কর আদায়ে আলাদা সংস্থা থাকা উচিত। ট্যারিফ কমিশন বা অন্য কোনো সংস্থা এটা করতে পারে।’
কিছু প্রকল্প মানুষের ভোগান্তির কারণ হচ্ছে উল্লেখ করে এই সাবেক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘অদক্ষতার কারণে অনেক প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বেড়ে যায়, এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি মানুষকে এত দুর্ভোগ দিচ্ছে। এটা নয় বছর ধরে চলছে। মানুষকে সীমাহীন কষ্ট দিচ্ছে। এর জন্য যারা দায়ী তাদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া উচিত।’
দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে আরও বেশি প্রণোদনা দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা ছোট, তাদের হয়তো কমপ্লায়েন্স নাই, কারও ট্রেড লাইসেন্স নাই, কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, এজন্য তারা বিভিন্ন প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হন। তারা কিন্তু এ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এটা আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে। তাই তাদেরকে কীভাবে সহযোগিতা দেয়া যায়, সেটা আমাদেরকে দেখতে হবে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমি একজন সচেতন দর্শক। ব্যবসায়ীরা যেসব দাবিদাওয়া করছেন, গত ১০ বছর ধরে দেখে আসছি। আমার মনে হয় না, আমার এ জীবনে এগুলো পুরোপুরি সমাধান হবে। সব সমাজে এসব সমস্যা আছে, হয়তো আমাদের এখানে বেশি। তার হয়তো সঙ্গত কোনো কারণ আছে।’
তিনি বলেন, ‘কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ আরও সহজ করা যায়, সেটি করা উচিত। এটা হয়তো পুরো মসৃণ হবে না। এমন অনেক কিছুই আছে, যা তাৎক্ষণিক সমাধান করা যায়। কিন্তু এক জায়গায় হাত দিতে গেলে ২০ জায়গায় নড়াচড়া হয়। ভয় এত বেশি মাথায় উঠে যে, আগায় না।’
অথরিটি শব্দটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, ‘অথরিটি শব্দটা অনেকেই পছন্দ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করেন না। কেন বিডা (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটি) হবে, বিপা (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি) হবে না? অথরিটি, মাই গড!’
তিনি বলেন, ‘অথরিটিকে কুর্নিশ করতে কে আসে? এগুলো তো মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য সেবা সংস্থা। এসব নিয়ে সরকারি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আরও আলোচনা বাড়াতে হবে।
‘অনেকগুলো ফিগার নিয়ে আমরা খুব বেশি লাফালাফি করছি। তবে যখন পুরো দুনিয়ার দিকে তাকাই, তখন দেখিই সেটা খুব বেশি না। ব্যবসায়ীদের সব দাবি-দাওয়া আমি সরকারের কাছে তুলে ধরব।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘ব্যবসায়ীদেরকে সহজে ব্যবসা করার সুযোগটা দেন। বছরের ৩৫ থেকে ৫০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য যুক্ত হচ্ছে, তাই এদেশের প্রচুর উদ্যোক্তা তৈরি করতে। এজন্য ব্যবসার পরিবেশ আরও সহজ হতে হবে। এইসব ডুইং বিজনেস সহজ হলেই দেশে আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, দেশে বিনিয়োগ বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। জার্মানি ও আমেরিকার মতো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হচ্ছে এসএমই। সুতরাং তাদের কথাই আগে ভাবতে হবে। এটা কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে বড় জায়গা।’
অনুষ্ঠানে ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে আয়কর, ভ্যাট ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২২টি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।