সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর তহবিলে জমাকৃত অর্থ লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। আর এই কর্তৃপক্ষকে সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ১৭ সদস্যের গভর্নিং বোর্ড।
চলতি বছরের মধ্যে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২ প্রণয়ন করেছে সরকার। আইনে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং তা পরিচালনায় সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে মাসিক পেনশন সংশ্লিষ্ট পেনশনারের কাছে প্রতি মাসে সুনির্দিষ্টি সময়ে পৌঁছানো নিশ্চিত করবে। এর জন্য জাতীয় পেনশন স্কিমকে প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সাপোর্ট দিতে এক বা একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংককে নিজস্ব ব্যাংকার হিসোবে নিয়োগ করা যাবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণীত আইনের প্রাথমিক খসড়ায় এসব সুপারিশ করা হয়েছে। মঙ্গলবার তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা এই স্কিমের আওতাধীন কোনো কার্যক্রম, স্কিম অথবা প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা কর্মচারী এই আইনের কোনো ধারা অথবা এর অধীনে প্রণীত কোনো বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে আদালতের মাধ্যমে তার এক বা একাধিক ব্যাংক হিসাব ক্রোক করতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
খসড়ায় কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম মনিটরিং ও নীতিনির্ধারণী বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে একটি গভর্নিং বোর্ড গঠনের কথাও বলা হয়েছে। ১৭ সদস্যের এই গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। সদস্য সচিব থাকবেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান। বাকিরা বোর্ডে সদস্য হবেন।
গভর্নিং বোর্ডের দায়িত্ব পালনে মনোনীত অপরাপর সদস্য হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সচিব, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সচিব, এফবিসিসিআই সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি এবং উইমেন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইনের পূর্ণাঙ্গ খসড়াটি প্রাথমিক। এর আরও পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। এজন্য প্রাথমিক খসড়ার ওপর ১২ এপ্রিলের মধ্যে বিভিন্ন মহলের মতামত চাওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যে কেউ দিকনির্দেশনামূলক নিজস্ব মতামত দিতে পারবেন। এরপর পূর্ণাঙ্গ খসড়া চূড়ান্ত করা হবে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়, প্রণীত আইনটি ‘সার্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন-২০২২’ নামে অভিহিত হবে। আইনে পেনশন পদ্ধতি চালু করতে গভর্নিং বোর্ড ও কর্তৃপক্ষ গঠন, ঢাকায় প্রধান কার্যালয়সহ প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের যে কোনো স্থানে শাখা স্থাপন ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা যাবে।
প্রণীত খসড়ায় জাতীয় পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত চাঁদাদাতা বা পেনশনারদের জমাকৃত অর্থের সুরক্ষা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে নিজস্ব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
সে অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা এই স্কিমের আওতাধীন কোনো কার্যক্রম, স্কিম অথবা প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা কর্মচারী এই আইনের কোনো ধারা অথবা এর অধীনে প্রণীত কোনো বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে আদালতের মাধ্যমে তার এক বা একাধিক ব্যাংক হিসাব ক্রোক করতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের আরেকটি বড় দায়িত্ব হলো, প্রতি বছর পেনশনারদের জমা দেয়া অর্থ লাভজনক খাতে বিনিয়োগের পর সুদসহ সমুদয় হিসাব জাতীয় বাজেট পেশের আগে সরকারকে জানাতে হবে।
খসড়ায় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় তহবিল ব্যবস্থাপনা কমিটির কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া আইন অনুযায়ী বিধিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
আইন অনুযায়ী গভর্নিং বোর্ডের দায়িত্ব হলো– পেনশন স্কিমে জমাকৃত অর্থ সরকারি সিকিউরিটিজ, কম ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য সিকিউরিটিজ, লাভজনক অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুমোদন দেয়া। এছাড়া সময়ে সময়ে কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেবে বোর্ড। এর পাশাপাশি আইনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রণীত প্রবিধান বা কর্তৃপক্ষের যেকোনো নীতি বা কৌশল অথবা কর্তৃপক্ষ উত্থাপিত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরামর্শ দেবে তারা। এ লক্ষ্যে গভর্নিং বোর্ড প্রতিবছর ন্যূনতম চারটি সভায় বসবে।
আইনের খসড়ায় কর্তৃপক্ষের কাজও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের কাজ হবে পেনশন পদ্ধতি চালুকরণ, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা; চাঁদাদাতার স্বার্থ সংরক্ষণ, জমাকৃত অর্থের সুরক্ষা প্রদান, স্কিমে প্রবেশের যোগ্যতা ও শর্ত নির্ধারণ, অনুমোদন, স্কিম পরিচালনা, তত্ত্বাবধান এবং পেনশন তহবিলে জমার পুঞ্জিভূত অর্থ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা।
জনগণকে পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করতে প্রচারণার উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্বও পড়েছে এই কর্তৃপক্ষের ওপর। এছাড়া চাঁদাদাতার অভিযোগ নিষ্পত্তি ও প্রতিকার প্রদান নিশ্চিতে সরকারের অনুমোদনক্রমে প্রয়োজনীয় প্রবিধান প্রণয়নের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষকে।
কর্তৃপক্ষের আরেকটি বড় দায়িত্ব হলো, প্রতি বছর পেনশনারদের জমা দেয়া অর্থ লাভজনক খাতে বিনিয়োগের পর সুদসহ সমুদয় হিসাব জাতীয় বাজেট পেশের আগে সরকারকে জানাতে হবে।
নিয়ম অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন যে কারও জন্য কমপক্ষে ১০ বছর চালিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক। তবে মাঝে কোনো পর্যায়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এককালীন টাকা তুলতে চাইলে পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনসাপেক্ষে জমাকৃত মোট অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসাবে উত্তোলনের সুযোগ থাকছে।
প্রণীত খসড়ায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি কেমন হবে তারও রূপরেখা দেয়া হয়েছে। আইন অনুযাযী, নির্দিষ্ট মেয়াদে সর্বজনীন পেনশন ম্যাচিউর হওয়ার আগেই তহবিলে জমা হওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট চাঁদাদাতা বা পেনশনার সুবিধাভোগীর জন্য তুলে নেয়ার সুযোগ থাকছে।
নিয়ম অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন যে কারও জন্য কমপক্ষে ১০ বছর চালিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক। তবে মাঝে কোনো পর্যায়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এককালীন টাকা তুলতে চাইলে পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনসাপেক্ষে জমাকৃত মোট অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসাবে উত্তোলনের সুযোগ থাকছে।
পেনশন সুবিধা অব্যাহত রাখতে তুলে নেয়া অর্থ সর্বজনীন ধার্যকৃত ফিসহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। তবে ফিসহ পরিশোধিত অর্থ চাঁদাদাতার নিজ হিসাবেই আবার জমা হবে।
পেনশন সুবিধায় নাম অন্তর্ভুক্তির পর মেয়াদ পূর্তির (কমপক্ষে ১০ বছর) আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে তার জমাকৃত অর্থ নমিনিকে মুনাফাসহ ফেরত দেয়া হবে। এর বাইরে যে কোনো পেনশনারই আমৃত্যু পেনশন সুবিধা পাবেন। তবে পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছরের আগেই কেউ মারা গেলে তার নমিনিও ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পেতে থাকবেন।
মাসিক চাঁদা দিতে বিলম্ব হলে বিলম্ব ফিসহ চাঁদা প্রদানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পেনশন সুবিধা চালু রাখতে পারবেন। আর বিলম্ব ফি-ও পেনশনারের হিসাবেই যোগ হবে।
সবার জন্য পেনশন আওয়ামী লীগের গত আমলের চিন্তা। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এ জন্য পাইলট প্রকল্পের কথাও বলেছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, সবার জন্য পেনশন আওয়ামী লীগের গত আমলের চিন্তা। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এ জন্য পাইলট প্রকল্পের কথাও বলেছিলেন তিনি।
সর্বজনীন পেনশনকে মুহিত তার স্বপ্নের প্রকল্প উল্লেখ করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কাজ চলেনি।
তবে সরকারের নানা কাজ যে পর্দার আড়ালে হয়েছে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন’ বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেয় অর্থ বিভাগ।
এরপর প্রধানমন্ত্রী ষাটোর্ধ্বদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন এবং কর্তৃপক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দেন। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে আইন করার উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দেন তিনি।
খসড়ায় আরও যা রয়েছে:
#১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী কর্মক্ষম সব নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারবে; জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে নাগরিকরা পেনশন হিসাব খুলবেন।
#বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরাও এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
#সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
#প্রাথমিক পর্যায়ে এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকলেও পরে তা বাধ্যতামূলক করা হবে।
# ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন হবে।
# প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে। ফলে তিনি কর্মক্ষেত্র পাল্টালেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে।
#এ পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে।
#মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে; তবে প্রবাসী কর্মীদের সুবিধার্থে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা জমার সুযোগ থাকবে।
#সুবিধাভোগী বছরে ন্যূনতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবে। অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হবে এবং পরে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা পরিশোধের মাধ্যমে হিসাব সচল করা হবে।
#সুবিধাভোগী আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসেবে বর্ধিত অর্থ (সর্বনিম্ন ধাপের অতিরিক্ত যেকোনো অঙ্ক) জমা করতে পারবেন।
#পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন প্রদেয় হবে।
#পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।
# নিম্ন আয় সীমার নিচে থাকা নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে।
#পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের খরচ বহন করবে সরকার।