এপারে ছিল বিজিবি, ওপারে বিএসএফের নজরদারি। তবু দুই দেশে বিভক্ত দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলায় বাধা হতে পারেনি তারা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বারুণী স্নানোৎসব ঘিরে এই মিলনমেলা হয়েছে খাগড়াছড়ির রামগড়ে।
বুধবার ভোর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নির্ধারণী ফেনী নদীর শূন্যরেখা বরাবর জড়ো হতে শুরু করেন দুই বাংলার মানুষেরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় নদী পার হওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না।
তবু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে অনেকেই দেখা করেছেন আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে। আর বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে এপারের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে গেছেন ওপার বাংলার অনেকে।
রামগড়ের আনন্দপাড়া, মহামুনী এলাকায় ফেনী নদীতে নেমে প্রতি বছরই পুণ্যস্নান করা হয়। নদীর দুই পাড়ে দুই দেশের সীমারেখায় পুরোহিতরা বসেন পুণ্যার্থীদের তর্পণ পাঠ, পূজা-অর্চনা ও শুদ্ধিব্রত করাতে। এ সময় দুই দেশের সংযোগস্থল ফেনী নদীতে জলকেলীতে মেতে ওঠেন পুণ্যার্থীরা।
দুই দেশের সীমারেখায় পুরোহিতরা বসেন পুণ্যার্থীদের তর্পণ পাঠ, পূজা-অর্চনা ও শুদ্ধিব্রত করাতে
হিন্দু পুরোহিত রমেন্দ্র আচার্য বলেন, ‘চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি পবিত্র দিন। এ দিনে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে পূজা দিয়ে প্রয়াতদের আত্মার সদগতি কামনায় স্নান করা হয়। এই বিশ্বাস শত শত বছর ধরে চলছে। দুই দেশের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের মিলনমেলাও এই স্নানোৎসব। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে পারাপার বন্ধ রয়েছে।’
ফেনী নদীর আনন্দপাড়া ঘাটে কথা হয় চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাটের রিনু শীলের সঙ্গে। নদীর পাড়ে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম বাজার ঘাটের দিকে।
রিনু শীল বলেন, ‘বাপের বাড়ি ঐ পাড়ে (ভারতের ত্রিপুরা)। বাবা-মা বেঁচে নেই। ভাইবোনরা আসবে বলছে। তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। অন্যান্য বছর নদী পার হয়ে বাপদাদার ভিটা দেখতে যেতে পারতাম, এখন পারছি না।’
রিনু শীলের মতো আরও কয়েক শ স্বজন অপেক্ষা করে ছিলেন নদীর অন্য পাড়ে থাকা স্বজন-পরিজনদের এক নজর দেখতে। এ সময় নদীর শূন্য রেখায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফের দেয়া অস্থায়ী সীমারেখায় ছিল কড়া নজরদারি। বিএসএফ, ত্রিপুরা রাজ্য পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা ছিলেন টহলে। তারপরও সুযোগ পেলে শূন্যরেখায় গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছেন অনেকে।
রামগড়ের আনন্দপাড়া থেকে মহামুনী পর্যন্ত ২ কিলোমিটারজুড়ে এমন দৃশ্য বারবারই দেখা গেছে।
শূন্যরেখায় দাঁড়িয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাংবাদিক প্রসেনজিৎ বৈদ্য জানান, বাংলাদেশের অনেক দর্শনীয় স্থান তিনি ইউটিউবে দেখেন। বান্দরবান দেখার ইচ্ছা তার অনেক দিনের। সুযোগ পেলে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসার আগ্রহও প্রকাশ করেন প্রসেনজিৎ।
ফেনী নদীর শূন্যরেখায় মুখোমুখি দুই বাংলার মানুষ
রামগড়ের বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন লাভলু বলেন, ‘বারুণী শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বারুণী স্নানে সম্প্রীতির মেলবন্ধন হতো ফেনী নদীতে। দেশ ভাগ ও স্বাধীনতার পর সীমান্ত জটিলতায় রামগড় ও ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে পারাপার বন্ধ হলেও প্রতিবছর বারুণী ঘিরে দুই বাংলায় পারাপার হতো। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতো এ উৎসব। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন অনেকে।’
তবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট ও পরে করোনা পরিস্থিতির কারণে সীমান্তে কড়াকড়ি শুরু হয় বলে জানান লাভলু। তিনি বলেন, ‘এবার নদীর শূন্যরেখা পারাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বারুণী স্নানোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
রামগড় থানার ওসি মো. সামসুজ্জামান বলেন, ‘বারুণী স্নানোৎসব ঘিরে দুই দেশের মানুষের মিলনমেলা হয়েছে। নদীতে গোসল, পূজাসহ অন্যান্য ভাবাচার হয়েছে। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্ত আইন মেনে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা টহল দিচ্ছেন।’