স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিহত ও লেখালেখি চিরতরে স্তব্ধ করতেই সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয়েছে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন বিচারক। বলেছেন, তাকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীলতা চর্চাকারীদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে চেয়েছিল খুনিরা।
চার আসামিকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে বুধবার সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব এই মন্তব্য করেন।
অনন্ত বিজয় বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ হিসেবে উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ‘তিনি ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন। তার স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে প্রতিহত করার জন্য এবং তার লেখনীকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য সন্ত্রাসী কায়দায় তাকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।’
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, যেসব লেখক মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান ও সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিষয়ে লেখেন বা বক্তব্য রাখেন, এই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ও বীভৎসতার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা ছড়িয়ে দেয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে পরের দুই বছরে হত্যা করা হয় মোটামুটি একই কায়দায়। কাউকে ঘরে ঢুকে, কাউকে রাস্তায় কোপানো হয়েছে।
২০১৫ সালের ১২ মে সিলেটে প্রধান সড়কে ব্যাংকার অনন্তকে হত্যা করা হয়।
আদালত মনে করে, জনমনে ভীতির সঞ্চার করে এবং জননিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে অনন্তকে হত্যা করে এই আসামিরা গর্হিত অপরাধ করেছেন, যা বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে অনুজ্জ্বল করেছে।
এ কারণে এই আসামিরা দণ্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের কোনো অনুকম্পার হকদার নন বলেও মনে করেন বিচারক। বলেন, ‘বরং এই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে অন্যান্য সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও উগ্রবাদী মতাদর্শের লোকজন এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে উৎসাহিত হবে।’
আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, অনন্তকে হত্যার পরপরই টুইটারে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এর দায় স্বীকার করলেও বাংলা টিম বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ সত্তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রমাণ হয়নি আদালতে।
মামলা থেকে সাফিউর রহমান ফারাবীকে খালাস দেয়ার বিষয়ে আদালত জানায়, হত্যার সময় ফারাবি অন্য মামলায় কারাগারে ছিলেন।
সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ আইনজীবী মোমিনুর রহমান টিটু বলেন, ‘মামলার রায়ে আদালত বলেছে যে হত্যাকারীরা একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। পরিকল্পিতভাবে তারা অনন্তকে হত্যা করেছে।’
চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায়ে দণ্ডিতরা হলেন কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন, খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বীরেন্দ্রনগরের মামুনুর রশীদ ওরফে হারুন অর রশিদ ও কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ।
খালাস পাওয়া ফারাবীর বাড়ি নগরের রিকাবীবাজার এলাকায়। তিনি ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি।
সম্পূরক অভিযোগপত্রে নাম আসা ৬ জনের মধ্যে ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর মান্নান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মারা যান। তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
যেভাবে হত্যা করা হয় অনন্তকে
২০১৫ সালের ১২ মে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও অফিসে যেতে সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা অনন্ত বিজয় দাশ। সিলেট নগরের সুবিদবাজারের দস্তিদারপাড়ায় থাকতেন তিনি।
বাসা থেকে বের হয়ে মূল সড়কে আসার পরপরই আগে থেকে ওত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা করে। তবে প্রাণভয়ে দৌড়াতে থাকেন অনন্ত। শেষে বাড়ির পাশে দিঘির সামনে নিয়ে তাকে কোপানো হয়।
অনন্তের চিৎকার শুনে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন তার বোন। অনন্তকে হাসপাতালে নিতে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের সাহায্য চান। কিন্তু ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে ক্ষতবিক্ষত অনন্তকে তার ভাই-বোন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মামলা, তদন্ত, বিচার
অনন্তকে হত্যার পরদিনই তার বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ সিলেট বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
এজাহারে বলা হয়, বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির কারণে অনন্তকে ‘উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী’ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
প্রথমে মামলাটি পুলিশ তদন্ত করলেও পরে তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তরিত হয়। সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী তদন্ত করে ২০১৭ সালের ৯ মে সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন। এতে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ১০ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
এই মামলায় সাক্ষী ছিলেন ২৯ জন। তবে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারায় অন্তত ১৫ দফা পেছায় মামলার শুনানি। এ ছাড়া করোনার কারণেও দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল মামলার কার্যক্রম।
অবশেষে মামলাটি দ্রুত শেষ করতে মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয় এর কার্যক্রম। এতে গতি আসে মামলার কার্যক্রমে।