করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে বিধিনিষেধ দেয়ার আগে বিএনপির নেতারা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে নামার কথা বারবারই বলে আসছিলেন। বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর নেতাদের বক্তব্যে গুরুত্ব পাচ্ছে বিভিন্ন দল ও মানুষের মধ্যে ঐক্যের বিষয়টি।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগেও একইভাবে বিএনপির নেতারা এক দফা আন্দোলনে নামার একাধিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে বিধিনিষেধ শেষে আর আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়নি।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সে সময়ের সরকারের এক বছর পূর্তির দিন সরকার পতনের ডাক দিয়ে ডাকা অনির্দিষ্টকালের হরতাল ও অবরোধ ভেস্তে যাওয়ার পর থেকে বিএনপি বড় ধরনের কর্মসূচিতে আর যায়নি।
দলীয় সরকারের অধীনে হবে বলে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা অংশ নেয় নির্বাচিত সরকারের অধীনেই।
এবার দলটি আবার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ফিরে গেছে। এই নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তাকে মেনে না নিয়ে আন্দোলনের কথাও বলেছিল দলটি। কমিশন গঠন হয়ে যাওয়ার পর এখন বিএনপি কী করতে যাচ্ছে, সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি।
কয়েক মাস আগে তাড়াহুড়োর বিষয়টি ফুটে উঠলেও এখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, তারা আন্দোলনে যাবেন, তবে সে জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম মেয়াদ থেকে নানা সময় ‘ঈদের পর আন্দোলনের’ ঘোষণা দিয়ে আলোচনা তৈরি করা নেতারা এখন আর কোনো সময় বেঁধে দিচ্ছেন না।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি একটি ম্যাচিউরড রাজনৈতিক দল। রাজনীতি কোনো ছেলেমানুষি খেলা নয়। জনগণের স্বার্থের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। জনগণ এখন বিপদগ্রস্ত। আমরা এখন জনগণের স্বার্থ দেখছি। আর আন্দোলন তো সময়ের দাবি।’
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি জনগণের দল। জনগণ এখন সরকারের হাতে জিম্মি। তাদের উদ্ধারে পরিবর্তন আবশ্যক। ঈদের আগে-পরে ব্যাপার নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐক্য নিয়ে আমরা জনগণের কাতারে দাঁড়াব। ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে নেয়ার যে দায়িত্ব তা অস্বীকার করা যায় না।’
গত বছর নভেম্বরে নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতা-কর্মীদের সমাবেশ। ফাইল ছবি
তৃণমূল গোছানোর কত দূর
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির পরিকল্পনা কী, তাদের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে কী করতে যাচ্ছে, বড় কর্মসূচিতে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা আছে কি না- এসব প্রশ্নের কোনো জবাবই আসলে কারও কাছে নেই। তবে বিএনপির সব কর্মসূচিতেই বলা হচ্ছে আন্দোলনের কথা।
বিএনপির পদক্ষেপ দৃশ্যমান না থাকলেও নেতারা বলছেন, মাঠপর্যায়ে দল গোছানোর কাজ চলছে। রাজধানী ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ধরে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে।
দলকে গতিশীল করতে মিডিয়া সেল, প্রযুক্তি ও গবেষণা সেল, প্রচার সেল, আইনি সহায়তা সেলসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডাক দিলেই নেতা-কর্মীরা যেন রাজপথে নেমে অবস্থান চালিয়ে যায়, এমন মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টাও হচ্ছে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হুজুগে কোনো কিছু না করে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। আর তার জন্য পিলার মজবুত হওয়া আবশ্যক। সে লক্ষ্যেই ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সারা দেশের ওয়ার্ড-ইউনিয়ন থেকে এসব সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে।’
এসব অঙ্গসংগঠনের বেশির ভাগ ইউনিটের কমিটি গঠন কার্যক্রম শেষ হয়েছে।
মূল দল বিএনপিতে সারা দেশের ৮০টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটির মধ্যে ৩০টি জেলা কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি এবং আটটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে রাজপথে দৃশ্যমান কর্মসূচিতে ফেরার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি এক ধরনের বার্তা রয়েছে।
জোট বড় করার উদ্যোগ নিয়ে চুপ
এসবের পাশাপাশি সরকারবিরোধী বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টাও চলছে। এই প্ল্যাটফর্মে ডান-বাম সব মতাদর্শকে এক কাতারে, এক মঞ্চে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ জন্য সরকারি দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ বাদে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সরাসরি কিছু না বললেও অস্বীকার করেননি।
কোন কোন দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে, আলোচনার অগ্রগতি কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা তো ঘরের খবর। সময় এলে ডেকে ডেকে জানানো হবে।’
নির্বাহী কমিটির বৈঠকে একদফা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। সেই বৈঠক করার কয়েক দিন পরই দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে গিয়েছিলেন দুর্নীতির মামলায়।
এরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন তারেক রহমান। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর গত সেপ্টেম্বরে দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সেই বৈঠকের নেতৃত্ব দেন।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে দুই দফায় তিন দিন করে ছয় দিনের এ বৈঠকে প্রায় ৩৫ ঘণ্টা আলোচনা হয়। রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে ২৮১ জন নেতা বক্তব্য দেন। মোটা দাগে নেতারা আগামী সংসদ নির্বাচন, সরকার পতন আন্দোলন, দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি, দল এবং জোটের ব্যর্থতা, দুর্বলতাসহ নানা বিষয়ে নিজেদের মতামত জানান।
বৈঠকে বেশির ভাগ নেতা সরকার পতনের একতরফা আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি দেখান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নেতাদের এই দাবিতে সম্মতি দেন।
বলা হয়, ২০২২ সালে নতুন বছরকে সামনে রেখে আন্দোলনের রূপরেখাও ঠিক করা হবে। কিন্তু সে রকম কোনো নজির এখনও চোখে পড়েনি। দলটির বিক্ষোভ কর্মসূচি প্রেস ক্লাবেই আটকে রয়েছে।
ক্ষমতার বাইরে প্রায় দেড় যুগ
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর সে সময়ের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে বিএনপি তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও সেই সরকারে দলটির প্রভাব ছিল। এক দফা পিছিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি হওয়ার কথা ছিল নবম সংসদ নির্বাচনের ভোট। তবে ১১ দিন আগে উল্টে যায় পাশার দান। হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ ছেড়ে জারি করেন জরুরি অবস্থা। তত্ত্বাবধায়কের প্রধান হিসেবে শপথ নেন ফখরুদ্দীন আহমেদ। তখন থেকেই রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে পুরোপুরি দূরে বিএনপি।
তত্ত্বাবধায়কের অধীনে শেষ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। ৩০টির কিছু বেশি আসন পেয়ে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে যায় দলটি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পরের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি সেটি নির্বাচিত সরকারের অধীনে হয়েছে বলে। সেই নির্বাচন ঠেকাতে সহিংস কর্মসূচি দিয়েও যখন কাজ হয়নি, তখন ভোট শেষে কর্মসূচি স্থগিত করে দলটি।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সরকার পতনের ডাক দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ডাকে বিএনপি। পরে অবরোধের পাশাপাশি ডাকা হয় হরতাল। কিন্তু সেই দুটি কর্মসূচিই একপর্যায়ে ভেস্তে যায়। আর ওই বছরের শেষ দিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি।
সেই অবরোধ ভেস্তে যাওয়ার পর বিএনপি আর কোনো বড় কর্মসূচিতে যায়নি। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের অধীনেই অংশ নেয় তারা।