বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলার রায় বুধবার ঘোষণা করা হবে। সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লবের আদালতে চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৭ বছর পর এই রায় দেয়া হচ্ছে। অনন্তের আইনজীবী ও পরিবারের সদস্যরা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন।
নিউজবাংলাকে তথ্য নিশ্চিত করে অনন্ত বিজয় হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের সদস্য মোহাম্মদ মনির উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে আজ এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। বেলা ১১টার দিকে আদালত বসবে, এরপরই রায় দেয়া হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আসামিদের অপরাধ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি রায়ে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’
ব্যাংক কর্মকর্তা অনন্ত বিজয় বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখি করতেন। ‘যুক্তি’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন আর যুক্ত ছিলেন মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে। এ ছাড়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। পুলিশের অভিযোগপত্র মতে, লেখালেখির কারণে উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাকে হত্যা করেছে।
যেভাবে হত্যা করা হয় অনন্তকে
২০১৫ সালের ১২ মে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও অফিসে যেতে সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা অনন্ত বিজয় দাশ। সিলেট নগরের সুবিদবাজারের দস্তিদারপাড়ায় থাকতেন তিনি।
বাসা থেকে বের হয়ে মূল সড়কে আসার পরপরই আগে থেকে ওত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা করে। তবে প্রাণভয়ে দৌড়াতে থাকেন অনন্ত। শেষে বাড়ির পাশে দিঘির সামনে নিয়ে তাকে কোপানো হয়।
অনন্তের চিৎকার শুনে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন তার বোন। অনন্তকে হাসপাতালে নিতে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের সাহায্য চান। কিন্তু ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে ক্ষতবিক্ষত অনন্তকে তার ভাই-বোন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী অনন্ত হত্যার প্রতিবাদে পরদিন জেলায় হরতাল ডাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত এই মোর্চা।
মামলা, তদন্ত, বিচার
অনন্তকে হত্যার পরদিনই তার বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ সিলেট বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
এজাহারে বলা হয়, বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির কারণে অনন্তকে ‘উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী’ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
প্রথমে মামলাটি পুলিশ তদন্ত করলেও পরে তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তরিত হয়। সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী তদন্ত করে ২০১৭ সালের ৯ মে সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন। এতে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ১০ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
ব্লগার অনন্ত বিজয়ের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
অভিযুক্তরা হলেন কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন, খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বিরেন্দ্রনগরের (বাগলী) মামুনুর রশীদ, কানাইঘাটের পূর্ব ফালজুর গ্রামের মান্নান ইয়াইয়া ওরফে মান্নান রাহী ওরফে এ বি মান্নান ইয়াইয়া ওরফে ইবনে মঈন, কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ এবং নগরের রিকাবীবাজার এলাকার সাফিউর রহমান ফারাবী ওরফে ফারাবী সাফিউর রহমান।
তাদের মধ্যে ফারাবী ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে মান্নান রাহী আদালতে অনন্ত হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
২০১৭ সালের ২ নভেম্বর মান্নান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আসামিদের মধ্যে আবুল হোসেন, ফয়সাল আহমদ ও মামুনুর রশীদ পলাতক রয়েছেন।
এই মামলায় সাক্ষী ছিলেন ২৯ জন। তবে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারায় অন্তত ১৫ দফা পেছায় মামলার শুনানি। এ ছাড়া করোনার কারণেও দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল মামলার কার্যক্রম।
অবশেষে মামলাটি দ্রুত শেষ করতে মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয় এর কার্যক্রম। এতে গতি আসে মামলার কার্যক্রমে।
সিলেটের সরকারি কৌঁসুলি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘এই মামলার ৬ জন আসামির মধ্যে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ। বাকি ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তিনজনকে পলাতক রেখেই বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।’
সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি
ছেলে হত্যার বিচার না দেখেই ২০১৭ সালের এপ্রিলে মারা যান অনন্ত বিজয় দাশের বাবা রবীন্দ্র কুমার দাশ। অনন্তর মা পিযুষ রানী দাশও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে তিনিও শয্যাশায়ী।
ছেলের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান তিনি।
অনন্তের ভগ্নিপতি সমর বিজয় শী শেখর বলেন, ‘ছেলে হত্যার বিচার না দেখে অনন্তের বাবা মারা গেছেন। মাও অসুস্থ। তিনি চান তার ছেলের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। আমাদেরও একই চাওয়া।’
গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের সংগঠক রাজীব রাসেল বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর হলেও অনন্ত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে জেনে আমরা খুশি। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমরা।’