ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুই শিশুকে হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার মো. সফিউল্লা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে মিষ্টি ও বিষ কেনার টাকা তিনি শিশুদের মাকে দিয়েছেন বলে আদালতকে জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মোল্লা মুহাম্মদ শাহিন।
তিনি জানান, মুখ্য বিচারিক হাকিম আফরিন আহমেদ হ্যাপির আদালতে মঙ্গলবার বিকেলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন সফিউল্লা। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এর আগে ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকে সোমবার বিকেলে সফিউল্লাকে গ্রেপ্তার করে আশুগঞ্জ থানা পুলিশ।
সফিউল্লার জবানবন্দির বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা শাহিন জানান, চালকলে কাজ করার সময় লিমা আক্তারের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। একপর্যায়ে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। তবে বিবাহিত লিমার দুই সন্তানকে তিনি পথের কাঁটা মনে করে সরিয়ে দিতে চান।
শাহিন জানান, সফিউল্লার পরিকল্পনায় রাজি হন লিমা। সে অনুযায়ী সফিউল্লা আশুগঞ্জের খড়িয়ালা গ্রাম থেকে ৫টি মিষ্টি ও এক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার কাছ থেকে পোকা মারার ওষুধ কেনেন। মিষ্টির সঙ্গে সেই ওষুধ মিশিয়ে লিমাকে দিয়ে শিশু দুটিকে খাওয়াতে বলেন। সন্দেহ এড়াতে নাপা সিরাপ কেনার জন্য লিমাকে টাকাও দেন তিনি। শিশুদের মৃত্যুর পর পরিকল্পনা অনুযায়ী নাপা সিরাপ খেয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচারণা চালানো হয়।
সফিউল্লা গ্রেপ্তার হওয়ায় স্বস্তি পেয়েছেন দুই শিশুর বাবা ও মামলার বাদী ইসমাঈল হোসেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সফিউল্লা ও লিমার ফাঁসি চাই। ফাঁসির পর মৃত অবস্থায় যেন তাদেরকে আমি দেখতে পারি। তাদেরকে যদি ফাঁসি না দেয়া হয়, তাহলে আমার সন্তানদের মতো আমিও পৃথিবী থেকে বিদায় নেব।’
আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের ইসমাঈল হোসেনের দুই ছেলে ৭ বছরের ইয়াসিন খান ও ৪ বছরের মুরসালিন খান গত ১০ মার্চ নাপা সিরাপ খেয়ে মারা যায় বলে অভিযোগ তোলেন স্বজনরা।
এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় ও জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পুরো জেলায় নাপা সিরাপ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি।
তবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নাপা সিরাপের একটি ব্যাচ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিরাপে কোনো সমস্যা পায়নি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
পরে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মোল্লা মোহাম্মদ শাহিন জানান, দুই শিশুর মৃত্যু নাপা সিরাপের কারণে হয়নি। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে শিশুদের হত্যা করেন তাদের মা লিমা। প্রেমিক সফিউল্লার এনে দেয়া মিষ্টির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে সন্তানদের খাওয়ান তিনি।
এ ঘটনায় তাদের বাবা ইসমাঈলের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মা লিমাকে।
হত্যায় অভিযুক্ত মা লিমা আক্তারকে নেয়া হয় আদালতে। ছবি: নিউজবাংলা
পুলিশের ওই কর্মকর্তা সে সময় বলেন, ‘পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে সন্তানদের হত্যা করেন লিমা। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেছেন মো. সফিউল্লা। সফিউল্লার সঙ্গে লিমার বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। লিমা গেল দুই বছর ধরে একটি চালকলে কাজ করছেন। সেখানে তার সঙ্গে সফিউল্লার পরিচয় হয়।’
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে জানান, যেদিন দুই শিশুকে বিষ মাখানো মিষ্টি খাওয়ানো হয়, সেদিন লিমার সঙ্গে সফিউল্লা ১৫ বার ফোনে কথা বলেন। তাদের ফোনকলের সূত্র ধরেই এই হত্যার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ।
পুলিশ সুপার বলেন, ‘চালকলে কাজ করার সুবাদে শ্রমিক সর্দার সফিউল্লার সঙ্গে লিমার বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লিমাকে আর্থিকভাবেও সহায়তা করতেন সফিউল্লা। সে জন্য লিমা সফিউল্লাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সফিউল্লার শর্ত ছিল, দুই সন্তানকে ছেড়ে আসতে হবে।’
‘শর্ত অনুসারে দুই সন্তানকে বিষ খাওয়ান লিমা। পরে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে ‘‘নাপা সিরাপ খেয়ে" দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করা হয়।’
জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম দ্বিতীয় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন লিমা। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।