১২ মার্চ, বেলা ১টা। ঘটনাস্থল কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন যাত্রী।
তাদের এতক্ষণ অপেক্ষা করার কথা ছিল না। কারণ, দাঁড়িয়ে থাকার সময় বিআরটিসির দুটি বাস সেখানে যায়। কিন্তু কাউন্টার থেকে দুটিকেই পাঠিয়ে দেয়া হয় পাশের ডিপোতে।
যাত্রীরা একপর্যায়ে কাউন্টারে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। পরে কাউন্টার থেকে গাড়ির খোঁজে বের হন টিকিট বিক্রেতা। তিনি গিয়ে দেখেন ট্রান্সসিলভা পরিবহনের একটি বাসের চালক ও সহকারী খাচ্ছেন। পরে তাদের ডেকে এনে বাস ছাড়ে।
ঢাকার বাস চলাচল পাল্টে দিয়ে যাত্রীবান্ধব ও আরামদায়ক করার ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চলা ঢাকা নগর পরিবহনে তিন মাস যেতে না যেতেই এই চিত্র দেখা দিয়েছে।
দীর্ঘ ৪০ মিনিট অপেক্ষার পর ঢাকা নগর পরিবহনের বাস আসে বসিলা কাউন্টারে। এ সময় ক্ষোভ জানিয়ে তারা বাসে চড়েন। ছবি: নিউজবাংলা
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে চিটাগাং রুটের কাঁচপুর পর্যন্ত এই রুট চালু হয়েছে গত ২৬ ডিসেম্বর। শুরুর দিন জানানো হয়েছিল, ৫০টি বাস আপাতত দেয়া হচ্ছে, পরে বাস বাড়বে। কিন্তু বাস বাড়েনি, উল্টো এই রুটে চলা বিভিন্ন বেসরকারি পরিবহনের বাস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে আরও বেশি।
এর মধ্যে আরও তিনটি রুটে নগর পরিবহন চালুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের পেছনে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের দৃষ্টিতে পরীক্ষামূলকভাবে চলা এই নগর পরিবহন পুরোপুরি সফল। কিন্তু যাত্রীরা কী ভাবছেন? ঘাটারচরে সেদিন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত যাত্রী সোহেল মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৩০ থেকে ৪০ মিনিট পরপর বাস ছাড়ে। এখন এক ঘণ্টা হয়ে গেল বাস পাই না। এভাবে সেবার নামে হয়রানি করার কী দরকার?’
যাত্রীরা জানালেন, সন্ধ্যার পর এই রুটে সেভাবে বাস পাওয়া যায় না। রাত ৮টার আগে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
বন্যা রায় নামে এক যাত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কাউন্টারে এসে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়। এদিকে শাহবাগ কাউন্টারে বসার জন্য যাত্রীছাউনি নাই। তারা সেবার নামে হয়রানি শুরু করেছে। বাস কম হওয়ায় গাদাগাদি করে চলতে হয়।’
গত ২৬ ডিসেম্বর ৫০টি বাস নিয়ে একটি রুটে পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির ৩০টি আর বেসরকারি বাস কোম্পানি ট্রান্সসিলভার ছিল ২০টি।
নগরীতে ওয়েবিলের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায়ের মধ্যে এই বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় হওয়ায় মানুষের খরচ কমে।
শুরুতেই এই সেবা যাত্রীদের স্বস্তির কারণ হয়েছিল। তবে মাস গড়াতে থাকলে সেবার মানে দেখা দেয় ঘাটতি। কমে গেছে বাস, বাহনে উঠতেই এখন কষ্ট হচ্ছে যাত্রীদের।
যাত্রা শুরুর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস জানিয়েছিলেন, ৬০ কর্মদিবসে আরও ৫০টি বাস দেয়া হবে।
শাহবাগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। দীর্ঘক্ষণ নগর পরিবহনের বাসের অপেক্ষায় যাত্রীরা। ছবি:নিউজবাংলা
কিন্তু ঘটনা ঘটেছে ঘোষণার উল্টো। বাসের সংখ্যা বাড়ার বদলে গেছে কমে। আর এ কারণে দীর্ঘ সময় কাউন্টারে অপেক্ষা করে যাত্রীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন।
বিআরটিসির বাস এখন দিনে ৩০টার জায়গায় চলে গড়ে ১৪ থেকে ১৮টা। আর ট্রান্সসিলভাও ২০টি বাস না চালিয়ে ১৩ থেকে ১৮টা চালায়।
৫০ দিনে কত বাস চলেছে
ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন যথাক্রমে বাস চলেছে ৩৮, ৩৭, ৪৩, ৩৬, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৩, ৪৩, ৪৬, ৪২, ২৯, ৪৪, ৩৯, ৩৯, ৩৬, ৩৬, ২৪, ২৪, ২৪, ২৪, ৩৩, ২৭, ২৭, ২৪, ২৭, ৩৫, ৩৫। ফেব্রুয়ারি মাসে মোট বাস চলেছে এক হাজার ২৫টি। গড়ে দিনে বাস চলেছে ৩৬.৬০টি।
চলতি মাসে ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন বাস চলার সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ৩৫, ৩৬, ৩৫, ২৭, ৩৪, ৩৫, ৩৪, ৩৬, ৩৮, ৩৬, ২৯, ৩৩, ৩৫, ৩৩, ৩৩, ৩১, ৩১, ২৭, ১৬, ৩২। মার্চের ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত মোট বাস চলেছে ৬৪৬টি। গড়ে দিনে বাস চলেছে ৩২.৩টি।
চলতি মাসের ২২ তারিখে বাস রুট রেশনালাইজেশনের ২২তম সভার দিন ৪৭টি ও আগের দিন বাস চলেছে ৪৫টি।
বাস থেকেও চলে না
ঢাকা নগর পরিবহন সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঘাটারচর থেকে গাড়ি ছাড়ে।
গত ১২ মার্চ মোহাম্মদপুর ডিপোর বিআরটিসির বাস চলেছে ৯টা। নারায়ণগঞ্জ ডিপোর বিআরটিসির বাস চলেছে ৯টা।
এর মধ্যে মোহাম্মদপুর ডিপোর ৯টি বাসের মধ্যে তিনটি বাস দুটি করে মোট ছয় ট্রিপ দেয়। বাকি ছয়টি বাস ট্রিপ দেয় একটি করে।
নারায়ণগঞ্জ ডিপোর ৯টা বাসের মধ্যে তিনটা বাস দুই ট্রিপ করে আর ছয়টি বাস একটি করে ট্রিপ দেয়।
একই দিনে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের ১৫ বাস চলে। এই বাসগুলোর মধ্যে ৯টা বাস দুটি করে ১৮টি আর ছয়টি বাস একটি করে মোট ২৪টা ট্রিপ দেয়।
অর্থাৎ সেদিন ট্রান্সসিলভা ও বিআরটিসি মিলিয়ে ট্রিপ দেয় ৪৮টি।
১৪ ঘণ্টায় ৪৮ বাস ট্রিপ দিলে হিসাবে ১৮ মিনিট পরপর গাড়ি ছাড়ার কথা। তবে মেয়রের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৫০ বাস যদি দুই ট্রিপ করে দেয়, তাহলে আট মিনিট পরপর বাস পাওয়ার কথা।
সেদিন দুপুরে ঘাটারচর গিয়ে দেখা যায়, বেলা ১টা ৫ মিনিটে বাস ছেড়ে যাওয়ার পর কাউন্টারে যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। এক ঘণ্টা ৪ মিনিট পরে বেলা ২টা ৯ মিনিটে ছাড়ে পরের বাস।
এত দেরিতে ছাড়ার কারণ হিসেবে কাউন্টার থেকে বলা হয়, ‘বাস নাই’।
তবে এই সময়ে বিআরটিসির দুটি দ্বিতল বাস কাউন্টারে আসে। দুটিকেই রাস্তায় না নামিয়ে পাশের ডিপোতে চলে যেতে বলা হয়।
নগর পরিবহনের একজন কর্মী বলেন, ‘গাড়ি ছিল, কিন্তু ছাড়ে নাই। যাত্রীদের আস্থা হারাচ্ছে। গাড়ি রানিং থাকলে যাত্রীরা নগর পরিবহনে চলে শান্তি পেতেন।’
‘লিখিত অভিযোগ দেন, ব্যবস্থা নেব’
এই বাস পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক ও বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির সদস্য সচিব নীলিমা আখতার বাস কম চলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ আমাদের কাছেও রিপোর্ট আছে। তাদেরকে চার্জও করা হয়েছে। তারা যে কেন এটা করছে তারাই (ট্রান্সসিলভা, বিআরটিসি) ভালো বলতে পারবে।
‘বিআরটিসি ও ট্রান্সসিলভা আইডেন্টিফাই করে মেয়র বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। আমরা ব্যবস্থা নেব।’
বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম প্রথমে বাস কমের বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে তা স্বীকার করেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাস আমরা কখনই কমাইনি। যাত্রীর চাহিদার ভিত্তিতে সর্বোচ্চসংখ্যক বাস দেয়ার নির্দেশ আছে আমার।’
বিআরটিসির বাস চলার কথা ৩০টি, কিন্তু চলে ১৪ থেকে ১৮টি- এই তথ্য তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘এটা আগে আমার নলেজে আসে নাই। আমি ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন এনেছি। আমার অপারেশন বিভাগই পরিবর্তন করেছি। সেখানে (ঢাকা নগর পরিবহন) আমাদের লোকেরা ঠিকমতো ডিল করতে পারে নাই। নগর পরিবহন আমার কাছে এক নম্বর প্রাধান্য। আমি চেষ্টা করি যাতে এই সেবা টিকে থাকে।’
ট্রান্সসিলভাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে চান না বিআরটিসির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘তাদের এখানে অনেক ঝামেলা আছে। তারা সব সময় চেষ্টা করে কীভাবে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়। তারা শুক্রবারে ট্রিপ বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলছে। আমি বলেছি ওকে। কিন্তু তারা ট্রিপ বাড়ায় নাই। তাদেরকে বলেছি আপনাদের যেভাবে সুবিধা হয়, ট্রিপ বাড়িয়ে দেন।’
মেয়র বলছেন, যাত্রীরা সন্তুষ্ট
মঙ্গলবার বাস রুট র্যাশনালাইজেশনের ২২তম সভায় কিছু বিষয় দুই সিটির মেয়রের সামনে তুলে ধরলে দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘প্রতিদিন আমরা এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করি। এটা আমাদের পরীক্ষামূলক রুট। প্রথম যখন আমরা শুরু করলাম, অনেকে অনেক কথা বলেছেন। এই বাস চলবে নাকি? যাত্রীরা উঠছে না, অন্য বাসে চলছে ইত্যাদি। এখন দেখেন যাত্রীরা অন্য বাস থাকার পরেও উঠতে চায় না। যাত্রীরা আমাদের বাসেই উঠতে চায়। তার মানে আমার যাত্রীসেবা সন্তোষজনক।’
লভ্যাংশে খুশি না ট্রান্সসিলভা
২০ বাস চলার কথা থাকলেও কেন ১৩ থেকে ১৮ বাস চালাচ্ছে ট্রান্সসিলভা?
পরিবহন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, তাদেরকে যে হারে লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে, সেটিতে পোষায় না।
তিনি বলেন, ‘বিআরটিসির কাছে আগে জিজ্ঞাসা করেন তারা কেন এত দিন বাস কম চালিয়েছে? তারপর আমার কাছে জিজ্ঞাসা করেন। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর মডেল বাস্তবায়নে তাদের তো বেশি ভূমিকা রাখতে হবে।’
এগুলো নিয়ে নগর পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি বলেও জানান তিনি।