কৃষিক্ষেত্রে ফরিদপুরের মাটির সুনাম দেশব্যাপী। এমন কোনো ফসল নেই যা ফরিদপুরের মাটিতে জন্মে না। এখানকার পাট ও পেঁয়াজ তো উৎপাদনে দেশসেরা।
সেই ফরিদপুরে আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। যে হারে তা কমছে, তাতে ভবিষ্যতে আবাদি জমির সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
১৯৯৯ সালে প্রণীত জাতীয় কৃষিনীতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় অপরিকল্পিত ইটভাটা, শিল্প-কারখানা স্থাপন, আবাসনসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠছে কৃষিজমিতে। ফলে গত ছয় বছরে জেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে গেছে।
ফরিদপুর জেলার প্রতিষ্ঠা ১৭৮৬ সালে। কেউ কেউ বলেন, সেটা হবে ১৮১৫ সাল। ফরিদপুরের নামকরণ করা হয়েছে এখানকার প্রখ্যাত সুফি সাধক শাহ শেখ ফরিদুদ্দিনের নামানুসারে। এ জেলার আগের নাম ছিল ‘ফতেহাবাদ’। ১৭৮৬ সালে ফরিদপুর জেলা প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময় এটির নাম ছিল জালালপুর এবং প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকা। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা জালালপুর থেকে বিভক্ত হলে এটি ফরিদপুর জেলা নামে অভিহিত হয় এবং সদর স্থাপন করা হয় ফরিদপুর শহরে।
গোয়ালন্দ, ফরিদপুর সদর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ এই চারটি মহকুমা সমন্বয়ে ফরিদপুর জেলা পূর্ণাঙ্গতা পায়। বর্তমানে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এই পাঁচটি জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর অঞ্চলের মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৩ লাখ ৩২ হাজার ৯১৮ হেক্টর। এর মধ্যে নিট ফসলি জমি ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৫৮ হেক্টর। পতিত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর। এক ফসলি জমি ১৪ হাজার ১৭ হেক্টর। দো-ফসলি জমি ৭১ হাজার ৭১২ হেক্টর এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ ৫২ হাজার ৪০৪ হেক্টর। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী ফরিদপুর জেলার মোট আয়তন ২ হাজার ৭৩ বর্গ কিলোমিটার (৮০০ বর্গমাইল)। মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৬৯৭ জন।
ফরিদপুর সদর ও ৯টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গত ৬ বছরে ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে ফসিল জমির পরিমাণ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জেলাজুড়ে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৮ হেক্টর। হ্রাস পেতে পেতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৩ লাখ ৩২ হাজার হেক্টরে এসে ঠেকেছে।
জেলা-উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন অবৈধভাবে আবাদি জমি ধ্বংস করে মাটি কাটা চলছে। জাঙ্গালিয়া এলাকা থেকে ভেকু মেশিন (খনন যন্ত্র) দিয়ে অবৈধভাবে মাটি খনন করে জাঙ্গালিয়া এবং বিলমান্দলার নতুন নির্মিত রাস্তা দিয়ে গাড়িতে মাটি নেওয়ার কারণে রাস্তার দুই পাশ ভেঙে যাচ্ছে।
ফরিদপুর শহর ঘেঁষে গ্রাম এলাকার কৃষিজমিতে একের পর এক গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা। এতে পরিবেশ ও ফসল উৎপাদন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বসতি স্থাপনেও কমছে আবাদি জমি।
পদ্মা নদী থেকে সারা বছর অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালি ও কৃষিজমির টপ সয়েলের সহজলভ্যতার কারণে এরই মধ্যে শহরসংলগ্ন ডিগ্রিরচর ইউনিয়নের সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকায় গড়ে উঠেছে একডজনেরও বেশি ইটের ভাটা। এর মধ্যে একেবারেই গ্রামীণ এলাকা আইজদ্দিন মাতুব্বরের ডাঙ্গিতে মাত্র ২০০ গজের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি ইটভাটা। এভাবে কৃষিজমির ওপর একের পর এক ইটের ভাটা গড়ে ওঠায় ফসলি জমি কমে যাচ্ছে।
জেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, আইজুদ্দিন মাতুব্বরের ডাঙ্গিতে কৃষিজমি ধ্বংস করে পাশাপাশি তিনটি ইটের ভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে চান মিয়া ও লিয়াকত মাতুব্বরের দুটি পুরোনো ভাটার পাশাপাশি আরশাদ ব্যাপারীর মালিকানাধীন এবিবি ব্রিক নামে নতুন আরও একটি ইটের ভাটা স্থাপন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি খলিফা কামাল উদ্দিন বলেন, ‘কৃষিজমি নষ্ট করে ভাটা তৈরি হোক এটা আমরাও চাই না। তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তর কীভাবে তাদের অনুমতি দেয়?’
সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফরিদপুরের নগরকান্দায় ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। এলাকা ঘুরে এমনই চিত্র দেখা যায়।
মাটি কাটছেন এমন একটি ফসলি জমির মালিক তালমা ইউনিয়নের বিলনালিয়া গ্রামের মোসলেম মোল্যা বলেন, ‘মাটির ভালো দাম পাওয়ায় জমির মাটি বিক্রি করে দিয়েছি। জমির ফসলে তেমন লাভ না হওয়ায় মাটি বিক্রি করে পুকুর খনন করছি।’
এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলার টোংরাইল গ্রামের সুনীল বিশ্বাস, কালি কুমার বালা, জয়দেব বিশ্বাস, সুতালীয়া গ্রামের অমর বিশ্বাস, ময়না গ্রামের মুকুল কুমার বোস, তারেক হোসেন, খরসুতি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আল মামুন রনি জানান, আগে যে পরিমাণ জমিতে তাদের পরিবার চাষাবাদ করত, এখন তার এক-পঞ্চমাংশ জমিতে তারা ফসল ফলান।
বোয়ালমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন মুশা মিয়া বলেন, ‘আবাদি জমি হ্রাসের নানা ধরনের কারণের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি বড় সমস্যা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের কৃষি ক্ষেত্রে। প্রতি বছর বেশ কয়েক শতাংশ হারে কমছে ফরিদপুরের আবাদি জমির পরিমাণ।’
নগরকান্দা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এন এম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে কৃষিজমির ক্ষতি করা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হযরত আলী বলেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাড়িঘর নির্মাণ, ফসলি জমিতে ইটভাটা, পুকুর খননসহ নানা কারণে দিন দিন ফসলি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।’