২১১ বছর আগে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামে জন্মেছিলেন শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অনাগ্রহী এই আধ্যাত্মিক পুরুষ সহজ সরলভাবে প্রচার করতেন প্রেম-ভক্তির কথা।
ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষীয় ত্রয়োদশী তিথিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাই প্রতিবছরই দেশের সবচেয়ে বড় স্নানোৎসব হয় ওড়াকান্দি গ্রামে। ঠাকুর বাড়ির পাশে ৬০ একর জায়গাজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় বারুনি মেলাও।
এই উৎসবে প্রতিবছরই যোগ দেন দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মতুয়া ভক্ত। হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রচারিত মতুয়া বিশ্বাসে কোনো দেব-দেবীর ঠাঁই নেই।
মঙ্গলবার শুরু হতে যাচ্ছে এবারের উৎসব। গত দুই বছর করোনার কারণে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে গত বছরের ২৭ মার্চ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঠাকুর বাড়িতে এসে পূঁজা অর্চনা করেছিলেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমনে ওড়াকান্দির ঠাকুর বাড়ির নাম বিশ্বজুড়ে আরও ছড়িয়ে পড়েছে।
ঠাকুর বাড়ি সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুর ১টায় হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরী ও স্নানোৎসব কমিটির সভাপতি দেবব্রত ঠাকুর বাপ্পীসহ ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা কামনা সাগরে (বড় পুকুর) স্নান করে উৎসবের উদ্বোধন করবেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উৎসব উপলক্ষ্যে ঠাকুর বাড়ি এলাকায় সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ চৌকি ও সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিরাপত্তা জোরদারে নিয়োজিত আছেন মতুয়া সংঘের প্রায় তিন শতাধিক স্বেচ্ছাসবকও।
পূন্যস্নান চলবে বুধবার দুপুর ১টা পর্যন্ত। তবে মেলা চলবে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত। মেলায় কুঠির শিল্পের সামগ্রী, বিভিন্ন খেলনা, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশের শিল্প, তালপাখা, মিষ্টি-মন্ডা, খাদ্য সামগ্রী, নাগরদোলা ছাড়াও শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে আরও নানা আয়োজন।
এই উৎসবকে ঘিরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক লাখ মতুয়া ভক্তের আগমন ঘটবে ওড়াকান্দির ঠাকুর বাড়িতে।
উৎসবকে সামনে রেখে কয়েকদিন আগে থেকে ওড়াকান্দিতে মতুয়া ভক্তরা জমায়েত হতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ ঠাকুর বাড়িতে বিছানা পেতে স্নানের অপেক্ষায় আছেন। কেউ আবার দোকানপাট পেতে বসেছেন।
বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার আমবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা বিপুল কুমার মিস্ত্রী বলেন, ‘আমি প্রতি বছর ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়িতে আসি। গত বছর করোনার কারণে স্নানোৎসব না হওয়ায় আসতে পারিনি। এবার কয়েকদিন আগেই এখানে চলে এসেছি। ঠাকুরের পূর্ণভূমিতে আসতে পেরে খুবই ভাল লাগছে।’
ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়িতে হরি মন্দিরের সামনে স্নানোৎসবে আসা পূণ্যার্থীরা
স্নানোৎসব ও মেলা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু সরকার জানান, উৎসবের সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। ভক্তদের জন্য বিশুদ্ধ পানি, প্রস্রাব-পায়খানা ও স্নান করে মহিলাদের কাপড় পাল্টানোর স্থান নির্ধারণসহ সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নির্মলেন্দু বলেন, ‘করোনার কারণে পর পর দুই বছর স্নানোৎসব ও মেলা বন্ধ থাকায় এবার বেশি লোকের আগমন ঘটবে বলে আশা করছি। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার কয়েক লাখ বেশি মানুষের আগমন ঘটতে পারে। বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশ থেকে মতুয়া ভক্তরা এই উৎসবে যোগ দেবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রথীন্দ্র নাথ রায় জানান, পূণ্যস্নানে আসা মানুষেরা যেন নির্বিঘ্নে উৎসব পালন করতে পারেন, সে জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একধিক আইনশৃংখলা সভা করা হয়েছে। ঠাকুর বাড়ি ও আশেপাশের এলাকায় সাদা পোশাকেও কয়েকশ পুলিশ নিযুক্ত থাকবে।
গোপালগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, পূর্ণার্থীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে রোগীদের হাসপাতালে নিতে মোতায়েন আছে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্সও।
হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরী ও কাশিয়ানী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর জানিয়েছেন, দেশ-বিদেশের ১০ লাখের বেশি মতুয়া ভক্ত এই স্নানোৎসবে যোগ দেন। হাতে বিজয় ও সত্যের লাল নিশান এবং ডাঙ্খা (বড় ঢোল) বাজিয়ে, উলু ধ্বনি দিয়ে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তারা ছুটে আসেন শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে। তারা প্রথমে কামনা ও পরে শান্তি সাগরে (বড় আকৃতির পুকুর) স্নান করে পাপ মোচন ও শান্তি কামনা করেন।’
অনুষ্ঠানটিকে নিরবিচ্ছিন্ন করতে তিন শতাধিক পুলিশ সদস্যের একটি শিপটিং ডিউটি রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান।
জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা জানিয়েছেন, উৎসবে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটও নিযুক্ত থাকবেন।