রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা আবু তায়েব আলী। রোববার রাতে খুলনা থেকে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের খাবার আসে তার বাসায়। ওই খাবার খাওয়ার পর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন তায়েবসহ পরিবারের তিন সদস্য।
সোমবার সকালে রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে ভর্তি হন তারা। তায়েব ও তার ছেলের শারিরীক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তার শাশুড়ি এখনও এই হাসপাতালে ভর্তি। শুধু তায়েব নন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ২০০ রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হচ্ছেন বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআর’বি কর্তৃপক্ষ।
আইসিডিডিআর’বি-এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ১০০ বাড়তি রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, হাসপাতালে ১৬ মার্চ ১ হাজার ৫৭ ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হন। পরদিন সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪১ জনে। ২০ মার্চ রোগীর সংখ্যা হয় ১ হাজার ১৫৭ , ২১ মার্চ ১ হাজার ২১৬, ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২ ও ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন।
এছাড়া ২৪ মার্চ ১ হাজার ৭৬, ২৫ মার্চ ১ হাজার ১৩৮, ২৬ মার্চ ১ হাজার ২৪৫, ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৩০ এবং ২৮ মার্চ ১ হাজার ৬৫৫ জন ভর্তি হয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, এমন রোগী চাপ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চোখে পড়েনি।
তারা জানিয়েছেন, রাজধানীর ঘিরে রাখা জেলাগুলো থেকে রোগী আসছে বেশি। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কদমতলী, দক্ষিণখান, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকেও রোগী আসছে বেশি। রাজধানীর বাইরের এলাকার মধ্যে বেশি রোগী সাভার, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহের।
সোমবার দুপুরে আইসিডিডিআর’বিতে গিয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপরই অ্যাম্বুলেন্সে ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে রোগীরা আইসিডিডিআর’বিতে আসছেন। রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদেরকে একদিনের বেশি ভর্তি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। রোগীদের বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক।
এ ছাড়া অনেক রোগী ভর্তি হওয়ার আগে বেশি দুর্বল হওয়ার কারণে হাসপাতালের মেঝেতেই শুয়ে পড়ছেন। তাদের যেখানে সেখানে বমি করতেও দেখা গেছে। বাড়তি রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে তাঁবু ফেলে চিকিৎসা দিচ্ছে আইসিডিডিআরবি। ছবি: নিউজবাংলাহাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগী বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। অনেক চিকিৎসকদের সাপ্তাহিক ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।
যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা আবুল কাশেমের ছয় মাসের কন্যাসন্তান সুমাইয়া ডায়ারিয়া আক্রান্ত হলে রোববার তাকে আইসিডিডিআর’বিতে ভর্তি করানো হয়। সোমবার তার শারীরের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও পুরোপরি সুস্থ নয় সুমাইয়া।
আবুল কাশেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুমাইয়া এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। তবে রোগীর চাপ থাকায় তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।’
আবুল কাশেমের দাবি, যাত্রাবাড়ীতে ওয়াসার লাইনে কাজ চলায় ওই এলাকার মানুষ ডায়রিয়াতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। একই কারণে কিছুদিন আগে তার বন্ধু ও তার স্ত্রী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।
জায়গা সংকটের কারণে আগেভাগে রোগীর ছাড়পত্র দেয়ার কথা শিকারও করেছেন আসিডিডিআরবির এক চিকিৎসক।
আইসিডিডিআর’বির বিজ্ঞানী শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, ‘যারা একটু সুস্থ হচ্ছেন বা মুখে খেতে পারছেন তাদের আমরা ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছি। অনেক রোগীকে সর্বোচ্চ একদিনের বেশি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে রোগী বেশি হওয়ায় দুটি নতুন তাঁবু তৈরি করা হয়েছে। আরও বেশি রোগী আসলে নতুন করে আর একটা তাঁবু তৈরি বা নতুন বানানো দুটি তাঁবু আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘স্যালাইন সঠিক নিয়মে পান না করানোর কারণে অনেকেরই ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। অনেকেই অল্প পানি দিয়ে ঘন করে খাই। আবার অনেকেই বেশি পানি দিয়ে পাতলা করে খাই। ডায়রিয়া সারাতে সঠিক নিময়ে খাবার স্যালাইন খেতে হবে। ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়েটিক খাওয়া যাবে না।’
আইসিডিডিআর’বির একজন বিজ্ঞানী লুবাবা শাহরিন বলেন, ‘প্রতিবছরই গরমের সময় এসে রোগী দেখা যায়। এবার একটু রোগীর চাপ বেড়েছে। হাসপাতালে স্বাভাবিক সময় ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী প্রতিদিন চিকিৎসা নেন। তবে মার্চের প্রথম থেকেই রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত এক সপ্তাহ থেকে ১ হাজার ২০০ বেশি রোগী প্রতিদিন ভর্তি করছি।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশিরভাগের মারাত্মক পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। তাদের অবস্থা জটিল হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সঙ্গে সঙ্গে যদি তাকে স্যালাইন দেয়া না হয়, তাহলে হাসপাতালে আসার পথেই মারা যেতে পারে।’
লুবাবা শাহরিন বলেন, ‘ডায়রিয়া হলে অবশ্যই খাবার স্যালাইন খেতে দিতে হবে। যদি অবস্থা বেশি খারাপ হয়, তাহলে আশপাশের হাসপাতালে নিয়ে স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু গরম পড়ছে, এসময় ঘনঘন নিরাপদ পানি পান করতে হবে। এই পানিটা আমরা সঙ্গে বহন করবো। উন্মুক্ত পরিবেশে অস্বাস্থ্যকর খাবার আমরা পরিহার করব। ঘন ঘন হাত ধোয়ার অভ্যাসটা রাখতে হবে।’
ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বাইরে খোলা জায়গায় অস্বাস্থ্যকর খাবার, অনিরাপদ পানি ও দূষিত শরবত এগুলো খাওয়ার কারণে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। এখন আমরা হয়তো খুব বেশি অসচেতন হয়ে গেছি।’