বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সংকটকালে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দুই অর্থনীতিবিদের

  •    
  • ২৮ মার্চ, ২০২২ ০৯:২৬

সংকট মোকাবিলায় আমদানির লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির দুই গবেষক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও আহসান এইচ মনসুর। একইসঙ্গে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে সরকার ও দেশবাসীকে অনুরোধ করেছেন তারা। সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন।

করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধরনের সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সব হিসাবনিকাশ পাল্টে গেছে; ব্যাহত হচ্ছে কোভিড-১৯ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম।

দেশের আমদানি খরচ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ডিসেম্বরের পর জানুয়ারি মাসেও আমদানি খাতে ব্যয় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার বেশি হয়েছে। চাহিদা বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে; দরও বাড়ছে। কমছে টাকার মান। চড়ছে মূল্যস্ফীতি। টান পড়ছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। সব মিলিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

এই সংকট মোকাবিলায় আমদানির লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির দুই গবেষক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও আহসান এইচ মনসুর। একইসঙ্গে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে সরকার ও দেশবাসীকে অনুরোধ করেছেন তারা। সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন।

অর্থনীতির গবেষক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। ফাইল ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৫ হাজার ৪৪ দশমিক ৯৩ কোটি (৫০.৪৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি।

এই সাত মাসে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে আরও বেশি, ৫২ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ৮ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এ খাতে ৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

লাগামহীন এই আমদানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। করোনার ধাক্কা সামলে ছোট-বড় সব দেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, তখনই যুদ্ধ সব তছনছ করে দিয়েছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। কবে এ সবের দাম কমবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সব দেশের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশেও বাড়ছে।’

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। ফাইল ছবি

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সাত মাসে ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি সত্যিই উদ্বেগজনক। এভাবে চলতে থাকলে এবার অর্থবছর শেষে মোট আমদানি ব্যয় ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যে করেই হোক এটা কমাতে হবে এবং দ্রুত কমাতে হবে। সরকারকে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের ব্যবহার যাতে কম হয়, সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে।’

‘দাম বাড়ায় সরকারের জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কয়েকগুণ বেড়েছে গেছে। একইসঙ্গে গ্যাসে ভর্তুকি বেড়েছে, সারে বেড়েছে। বিদুৎতে বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ পড়বে।’

এক্ষেত্রে এখন করণীয় কী- এ প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘সরকারকে সাশ্রয়ী হতে হবে। একইসঙ্গে দেশের মানুষকেও সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কম খরচ করতে হবে। আমাদের অনেক কিছুই কিন্তু জ্বালানি তেলের উপর নির্ভরশীল। গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার, পানি-এ সব কিছু উৎপাদনে তেলের প্রয়োজন হয়। এই সংকটের সময়ে এ সব কিছু যদি মানুষ কম ব্যবহার করে।

‘পরিবহন খাতে যদি জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো যায়, তাহলে আমদানি খাতে খরচ কমবে। সরকারের ভর্তুকি কমবে। অন্যদিকে বিলাসবহুল পণ্য যাতে কম আমদানি হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। একেবারে প্রয়োজন নেই এমন পণ্য আমদানি থেকে এখন বিরত থাকতে হবে।’

এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে স্বল্পমেয়াদি একটি দিকনির্দেনা দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কোমরের বেলটা আরও টাইট করতে হবে। যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই। তাই আমদানি কমিয়েই বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।’

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল তেলের দাম; একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেলের দর ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। সপ্তাহখানেক তা ১০৮ থেকে ১২০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। যুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে নতুন করে আলোচনায় বসার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার খবরে তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি প্রশমিত হয়। ১০০ ডলারের নিচে নেমে আসে।

কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরে তা ফের ফের ছুটছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট অপরিশোধিত তেল ১২১ ডলারে বিক্রি হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে ভাবা হয়েছিল, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সম্মানজনক সমাধান হবে। যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে খুব একটা পড়বে না। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলো, যুদ্ধ তো থামছেই না। দিন যতো যাচ্ছে, সংকট ততো বাড়ছে। জ্বালানি তেল, খাদ্যসহ সবকিছুর দাম বাড়ছে।’

পরিবহন খাতে যদি জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো যায়, তাহলে আমদানি খাতে খরচ কমবে। সরকারের ভর্তুকি কমবে। ফাইল ছবি

তিনি বলেন, ‘আমাদের আমদানি খাতে খরচ যেটা বাড়ছে, যেটা কিন্তু পণ্যর দাম বাড়ার কারণেই বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বাড়তে থাকে। একইসঙ্গে জাহাজ ভাড়া দুই গুণ-আড়াই গুণ বেড়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে জিনিসপত্রের দামে। ছোট-বড় সব দেশেই মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকে।

‘যুদ্ধের কারণে আরেক দফা বাড়ে সকল পণ্যের দাম। এখনও বেড়ে চলেছে। একটা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি গোটা বিশ্ব। কবে স্বাভাবিক হবে কেউ জানে না। এ অবস্থায় সতর্কতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে হবে।’

আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘একটা দিক দিয়ে আমরা স্বস্তির মধ্যে আছি। সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোতে আমাদের ধানের ভালো ফলন হয়েছে। দেশে প্রচুর ধান-চাল মজুদ আছে। সরকারের গুদামগুলোতেও মজুদ পরিস্থিতিও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিছুটা কমলেও আমাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এখনও সন্তোষজনক অবস্থায় আছে; তবে এর থেকে আর যেনো না কমে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।’

‘আমরা যদি সাশ্রয়ী হয়ে আমদানির লাগামটা টানতে পারি। সরকার যদি কৃচ্ছসাধন করে, দেশবাসী যদি সঙ্কটের বিষয়টি অনুধাবন করে সব অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে, তাহলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হবে।’

চাপে রিজার্ভ

গত ৬ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যা ছিল গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

প্রথমবারের মতো আকুর ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আকুর ২ বিলিয়নন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কখনই আকুর এতো বিশাল অঙ্কের বিল শোধ করা হয়নি।

এর আগে নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদে ১৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যা ছিল গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ফাইল ছবি

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।

রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় গত কয়েক দিনে রিজার্ভ বেড়ে রোববার ৪৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ছবি: এএফপি

বর্তমানে মাসে ৮ বিলিয়ন ডলারের আমদানির খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। অথচ ছয় মাস আগেও এই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা দিয়ে ১০ মাসের আমদানি খরচ মেটানো যেতো।

এ বিভাগের আরো খবর