বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাদুঘরে অতীতের গৌরব

  •    
  • ২৮ মার্চ, ২০২২ ০৮:৩০

বিদায়ী জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দীর্ঘদিন ধরে এখানে একটি জাদুঘর তৈরির দাবি ছিল। তাই এই জেলা সম্পর্কে স্থানীয় ও বাইরের মানুষকে জানাতে জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছে।’

প্রচলিত আছে, দিল্লি থেকে আগত ইসলাম ধর্মের প্রচারক শাহ সুফি হজরত কাজী মাহমুদ শাহ এই শহর থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার এমন বীজ লুকিয়ে থাকলেও এই অঞ্চলটি আক্ষরিক অর্থেই একসময় সাংস্কৃতিক রাজধানী ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল।

এই মাটিতেই জন্ম নিয়েছিলেন সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ব্যারিস্টার এ রসুল, নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কথাসাহিত্যিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণ, কবি আবদুল কাদির, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ বহু জ্ঞানীগুণী।

তা ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫ সহস্রাধিক মানুষ ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছে। বলা হয়, বিচ্ছিন্ন কিছু দালাল-রাজাকার ছাড়া তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার প্রায় ১০ লাখ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মোট ১১টি সেক্টরের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ অঞ্চল ছিল ২ নম্বর এবং কিছু অংশ ৩ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত।

তবে সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হলেও এগুলোর স্মৃতি সংরক্ষণে ছিল না কোনো জাদুঘর। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছুই আজ হারিয়ে গেছে। তাই অবশিষ্ট স্মৃতিগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পর মুজিববর্ষে উদ্বোধন হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর।

জেলা শহরের দক্ষিণ মৌড়াইলের থাকা পুরাতন ভূমি অফিসটিকে জাদুঘরে রূপ দেয়া হয়েছে। সদ্যোবিদায়ী জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান প্রধান অতিথি হয়ে জাদুঘরটির উদ্বোধন করেন।

উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর জেলা সভাপতি ও লেখক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খানের কাছে একটি জাদুঘর তৈরির প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। জেলা প্রশাসক প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং নিজে সভাপতি হয়ে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করেন। পরে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর থেকে জাদুঘরে রাখার জিনিসপত্রগুলো বিভিন্নভাবে সংগ্রহ শুরু হয়।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ মৌড়াইলের পুরাতন ভূমি অফিসে জাদুঘরের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ শুরু হয়। অফিসটিকে জাদুঘরে রূপ দেয়ার তত্ত্বাবধানে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রুহুল আমিন।

দীর্ঘ ১ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর’ এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। বর্তমানে এই জাদুঘরে ১১১টি উপকরণ রয়েছে। সবচেয়ে পুরাতন যে জিনিসটি রয়েছে, সেটি হচ্ছে হাজার বছর আগের একটি ফসিল।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জাদুঘরটিতে চারটি কক্ষ। প্রথম কক্ষে মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিতীয়টিতে ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং তৃতীয়টিতে সংস্কৃতিবিষয়ক স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাকি কক্ষটি জাদুঘরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জহিরুল হক চৌধুরী জানান, প্রথম কক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি নিদর্শন সংরক্ষিত। এর মধ্যে আছে নির্বাচনের আগে ১৯৭০ সালের ৯ নভেম্বর নিয়াজ স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ দেয়ার ছবি। সে সময় তিনি নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের থানাকান্দি গ্রামের খায়ের মিয়ার দাওয়াতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছিলেন।

এই কক্ষে আরও আছে ২ নং সেক্টরের মানচিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি, পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ফাস্টএইড বক্স, গুলির বক্সসহ অন্যান্য উপকরণ। এ ছাড়া আছে ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছবি, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি গোলাম মোস্তফা কামালের ছবিও।

ঐতিহ্যের জন্য নির্ধারিত দ্বিতীয় কক্ষটিতে আছে ৫৯টি উপকরণ। জহিরুল হক স্বপন জানান, এখানে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের ছবিসহ আছে কাইতলা জমিদার বাড়ি, সরাইলের হাতির পুর, হাঁসলি মোরগের লড়াই, পুতুল নাচ, নৌকাবাইচ, যাত্রাগান, কবিগান, গোকর্ণ নবাববাড়ীর ছবিও।

হাজারও বছরের পুরোনো দুটি জীবাশ্ম ছাড়াও আছে আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা কলের গান, ১৫০ বছর আগের পিতলের হুক্কা। আছে ১৯৫৪ সাল ও পরবর্তীকালের রেডিও, রাণী সরোজিনীকে পাঠানো রাণী এলিজাবেথের দুটি সিরামিক পেয়ালা, ১৪০ বছর আগের নান্দনিক নারিকেল কোড়ানি, কাজিপাড়ার সৈয়দ নাবালক মিয়ার স্ত্রী রমজান বিবির ব্যবহৃত ১৯১৩ সালের একটি ব্লাউজ। আছে ৫৯টি দুষ্প্রাপ্য মুদ্রাও।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তৃতীয় কক্ষটিতে ১৮টি উপকরণের মধ্যে আছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খা, ওস্তাদ রওশন আরা অন্নপূর্ণা, সুরের দরবেশ আফতাব উদ্দিন, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সাংবাদিক সামিউল হক খান ফটিক, কবি আবদুল কাদের মাশরেকি, কবি খান মোহাম্মদ ফারাবির ছবি। নাসিরনগরের দেশবিখ্যাত বাউল অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী, তার ওস্তাদ জারু মিয়ার ভায়োলিন ও দুতারাসহ আছে আরও অনেক কিছু।

আর কার্যালয়ে আছে জাদুঘর গ্রন্থাগার, শিল্পী অর্চির আঁকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৭টি ছবি, সদ্যঃপ্রয়াত সাইফুল ইসলাম রিপনের আঁকা ৫টি ছবি।

জাদুঘরের লোকজ কর্নারে ১১টি নিদর্শন রয়েছে, যার মধ্যে আছে প্রজাবন্ধু অফিসের উত্তরে ২৫ ফুট মাটির গভীরে পাওয়া সাড়ে তিন শ বছর আগের নোঙর, বৈঠা, কাপাইর, চাঁই, সরা, ডাবুর, ডেউয়া, খড়ম, কলস ইত্যাদি।

জহিরুল হক স্বপন জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন প্রতিটি উপকরণ খাতায় রেজিস্ট্রি করতেন। জাদুঘর স্থাপনে দিনরাত শ্রম দিতেন।

শিল্পগুলো সংগ্রহের কাজে যুক্ত ছিলেন উদীচী জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস রহমান, সহসভাপতি ফারুক আহমেদ ভূঁইয়া, তিতাস পত্রিকার সম্পাদক রেজাউল করিম, অধ্যাপক এ এস আর ওসমান গণি সজিব, মমিনুল হক বাবু, কবি জয়দুল হোসেন, জামিনুর রহমান প্রমুখ।

লেখক ও সাংবাদিক রেজাউল করিম বলেন, ‘জাদুঘরে রাখার অনেক কিছুই ছিল। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, চুরিও হয়েছে কিছু।’

জাদুঘরের জন্য বিদায়ী জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্ম এই জাদুঘর থেকে অনেক কিছুই জানতে পারবে।’

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি জয়দুল হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির রাজধানী এই জেলায় দীর্ঘদিন ধরে একটি জাদুঘরের দাবি ছিল। আজ তা পূর্ণ হয়েছে।’

বিদায়ী জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দীর্ঘদিন ধরে এখানে একটি জাদুঘর তৈরির দাবি ছিল। তাই এই জেলা সম্পর্কে স্থানীয় ও বাইরের মানুষকে জানাতে জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর