করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বাজেটে বরাদ্দের দিক থেকে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ে এবার বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের চিত্রে সেই হতাশার চিত্রই ফুটে উঠেছে।
বিগত বছরের মতো চলতি অর্থবছরেও ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ব্যয়ের দিক থেকে ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে স্বাস্থ্য খাত কিছুতেই বের হতে পারছে না।
রোববার প্রকাশিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার স্বাস্থ্য সেবা খাতে মাত্র ২২ শতাংশ। আর স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে বাস্তবায়ন হার ২৮ শতাংশ।
সব মিলিয়ে আলোচ্য অর্থবছরের আট মাসে গড়ে স্বাস্থ্যে উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশের সামান্য বেশি। পরবর্তী চার মাসে বরাদ্দ বাকি অর্থ ব্যয় নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এডিপিতে মোট বরাদ্দের ৮৪ শতাংশ অর্থ খরচ হয় সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১৫টি মন্ত্রণালয়ে, যার মধ্যে স্বাস্থ্য অন্যতম।
চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অনুকূলে মোট বরাদ্দ দেয়া হয় ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেট বরাদ্দের সাড়ে পাঁচ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যের বেশির ভাগ প্রকল্প বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট। বিদেশি প্রকল্পে অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হয়। ফলে অর্থ যথাসময়ে খরচ করা যায় না।’
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে এডিপিতে মোট ৬০টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে রয়েছে ৪৬টি। বাকি ১৪টি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের।
আইএমইডির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এডিপিতে স্বাস্থ্য সেবা খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বর্তমান অর্থবছরে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে বরাদ্দ দেয়া হয় ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের এ পর্যন্ত সময়ে খরচ হয়েছে মাত্র ৭৩৪ কোটি টাকা।
সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সে সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থহীন ব্যয়ের অভিযোগগুলোরও সমাধান করতে হবে। এ খাতকে ঢেলে সাজাতে দীর্ঘমেয়াদে একটি রোডম্যাপ বা পথনকশার তাগিদ দেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বাজেটে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয় সেটাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। আবার বরাদ্দের বেশিরভাগ টাকা চলে যায় ভৌত অবকাঠামো, বেতন-ভাতা ও প্রশাসনিক ব্যয়ে।
‘প্রকৃতপক্ষে রোগীর সেবার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। তবে এটাও ঠিক, শুধু বরাদ্দ বাড়ালে হবে না। সে সঙ্গে এ খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার করতে হবে।’
এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এডিপির আকার ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের আট মাসে খরচ হয়েছে ৮৪ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে সামগ্রিকভাবে বাস্তবায়নের হার ৩৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে গত বারের চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ বেশি অগ্রগতি হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে বাস্তবায়ন হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারিতে তা ছিল ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক ও বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘বাংলাদেশে এডিপি বাস্তবায়নের দুর্বল দিক হচ্ছে অর্থবছরে প্রথম দিকে খুব কম ব্যয় হয়। শেষদিকে ব্যয়ের চাপ বেশি থাকায় কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে। এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে।’
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের আট মাসে বাস্তবায়নের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে শিল্প, স্থানীয় সরকার ও ধর্ম মন্ত্রণালয়।
অপরদিকে কম বাস্তবায়নের তালিকায় আছে নৌপরিবহন, সেতু বিভাগ ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়।