দেশের সমাজ বাস্তবতার কারণে মানসিক বিষণ্নতায় ভোগেন অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েরা। তাদের এই সংকট দূর করতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার একটি মডেল দাঁড় করিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, স্কুলভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের বিষণ্নতার অবস্থা পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব। এর জন্য একজন মাকে গুণতে মাত্র ৮০ টাকা।
গবেষণার মাধ্যমেই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে আইসিডিডিআরবি।
রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্লোবাল মেন্টাল হেলথ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি সম্পর্কে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নেতিবাচক ধারণা ও সেবাদানে বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশে যে শিশুদের অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার রয়েছে, তাদের মায়েদের প্রতি দুই জনের মধ্যে একজন বিষণ্নতায় ভোগেন।
২০১৭ সালে একটি গবেষণার অংশ হিসেবে বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সার্ভিস নামে একটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করে ঢাকার অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এবং সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অফ অটিস্টিক চিলড্রেন।
গবেষণাটির শিরোনাম ছিল ফিজিবিলিটি অফ ইমপ্লেমেন্টিং আ মেন্টাল হেলথ কেয়ার প্রোগ্রাম অ্যান্ড হোম বেসড ট্রেইনিং ফর মাদারস অফ চিলড্রেন উইথ অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ইন এন আরবান পপুলেশন ইন বাংলাদেশ (মেনথল)।
গবেষণায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবার একটি পদ্ধতি পরীক্ষা করেন গবেষকরা। দেশের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিটি প্রণয়নে সহায়তা করেন।
বিশেষভাবে সাজানো এই সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সেবাটি বিদ্যালয় দুটিতে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ছয় মাসের জন্য চালু করা হয়েছিল। এটি ওইসময়ে বিদ্যালয় দুটিতে অধ্যয়নরত সব শিশুর মায়েদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
এই পদ্ধতিটি প্রয়োগে বেশির ভাগ মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি।
সংস্থাটি বলছে, বিষণ্ণতা পরিমাপের স্কেল অনুযায়ী যেসব মায়েদের পূর্বে বিষণ্নতা ছিল তাদের ৪০ শতাংশ এবং যেসব মায়েদের বিষণ্নতা ছিল না তাদের ২৩ শতাংশের মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। সেবাটি নিতে একজন মাকে খরচ করতে হয়েছিল মাত্র ৮০ টাকা।
চারটি সেশন নেয়ার পর প্রায় অর্ধেক মায়েদের মানসিক অবস্থার উন্নতি দেখা গেছে বলেও জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি। এত তাদের জীবনযাত্রার মানেও উন্নতি দেখা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্যানেলের সদস্য, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ এই গবেষণাপত্রের একজন লেখক।
তিনি বলেন, ‘অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বাবা-মা শুধুমাত্র শিশুকে লালন-পালনের চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করে না বরং প্রতিনিয়ত সামাজিক বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা এখনও একটি অবহেলিত বিষয়।’
মেনথল গবেষণা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কীভাবে দেয়া যেতে পারে এবং কীভাবে একটি বিশেষায়িত সেবায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে সেবাটিকে কার্যকর করা যায়।’
মেনথল গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক প্রফেসর কেরিম এম মুনির বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের বিষণ্নতার হার বেশি এবং এই বিষণ্নতা জীবন যাপনের মান অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, যা শিশুর যত্ন নেয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’
মেনথল সার্ভিস মডেল অটিজম এবং মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মতো দুটি সংবেদনশীল বিষয়কে একসঙ্গে সেবা দিতে পারছে বলেও মনে করেন তিনি।
কেরিম এম মুনির বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, খুব অল্প খরচে এবং খুব অল্প সময়ের ভেতরে এই পদ্ধতি সুফল দিয়েছে, যা সত্যিই অসাধারণ।’
হার্ভাড মেডিক্যাল স্কুল গ্লোবাল হেলথ ডেলিভারি-দুবাইয়ের ডিরেক্টর প্রফেসর সালমান এ কেশাভজি বলেন, ‘এই গবেষণাটি দেখিয়েছে যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকেও কীভাবে উচ্চ মানের সেবা প্রদান করা যায়, যেটি তাদের ভীষণ প্রয়োজন।’
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটিকে একটি রোডম্যাপ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
গবেষণার ফল নিয়ে প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. আলিয়া নাহিদ বলেন ‘আমি আনন্দিত যে আমরা একটি সাশ্রয়ী মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মডেল খুঁজে পেয়েছি, যা বাংলাদেশ এবং অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে বড় পরিসরে সহজে প্রয়োগ করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে৷’
বাংলাদেশের যেখানেই অটিজম সেবার সুযোগ রয়েছে সেখানেই দ্রুততম সময়ে এই সেবা মডেলটি চালুর সুপারিশ করেছেন তিনি।
আলিয়া নাহিদ বলেন, ‘নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে তাদের অটিজম সেবার সঙ্গে মেনথল সার্ভিস মডেলকে যুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করার কাজটি এখনই শুরু করা উচিত।’
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সব শ্রেণীর জনগণের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহজে পৌছে দেয়া সম্ভব বলেও মনে করেন আলিয়া।
আইসিডিডিআরবির সায়েন্টিস্ট ও ইনিশিয়েটিভ ফর ননকমিউনিকেবল ডিজিজেসের হেড ড. আলিয়া নাহিদের গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন।
আর এতে সহযোগিতা যুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন চিলড্রেন্স অ্যান্ড হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল, সূচনা ফাউন্ডেশন, ইন্সটিটিউট অফ পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড হসপিটাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটাল।