রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ‘বিষপানে’ দুই সাঁওতাল কৃষকের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে সেচের জন্য নলকূপের পানি না পাওয়ায় আত্মহত্যার দাবি করা হলেও পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পুলিশ কাজ করছে।
নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই সঙ্গে দুই কৃষকের মৃত্যুর পেছনে নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াতের কোনো ভূমিকা আছে কি না তা তদন্ত করছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।
গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমঘুটু গ্রামের বাসিন্দা দুই কৃষক অভিনাথ মারাণ্ডি ও রবি মারাণ্ডি বুধবার সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পরপরই মারা যান অভিনাথ। আর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শুক্রবার রাত ৮টার দিকে মারা যান তার চাচাতো ভাই রবি।
অভিনাথের পরিবারের দাবি, জমিতে সেচ দিতে না পারার কারণেই তিনি ক্ষোভে-দুঃখে বিষপান করেন।
তবে বিষপানই এ দুজনের মৃত্যুর কারণ কি না তা নিশ্চিত হওয়া যাবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর। অভিনাথের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে বৃহস্পতিবার। আর রবির মরদেহের ময়নাতদন্ত হয় শনিবার।
অভিনাথের পরিবারের দাবি, অনেক ঘুরেও গভীর নলকূপ থেকে সেচের পানি পাচ্ছিলেন না তারা। তাই ক্ষোভে গত বুধবার সন্ধ্যার দিকে ওই নলকূপের সামনেই দুজনে বিষপান করেন।
আমরা অসুস্থ রবি মারান্ডির কাছ থেকে ভালো কিছু তথ্য পাব বলে আশা করছিলাম। বুধবার রাতে হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি আসলে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। তার কথাগুলো ছিল অসংলগ্ন। কোনো কথা বোঝা যাচ্ছিল, আবার কোনোটি ছিল অস্পষ্ট।
এ ঘটনায় গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে আসামি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেছেন অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম। সাখাওয়াত দেওপাড়া ইউনিয়নের কৃষক লীগ নেতা।
গোদাগাড়ী থানা পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করলেও রাজশাহী জেলা পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা তদারকিতে রয়েছেন।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টিকে স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করেই তদন্ত করছে পুলিশ। এখানে অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে।
‘আমরা অসুস্থ রবি মারান্ডির কাছ থেকে ভালো কিছু তথ্য পাব বলে আশা করছিলাম। বুধবার রাতে হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি আসলে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। তার কথাগুলো ছিল অসংলগ্ন। কোনো কথা বোঝা যাচ্ছিল, আবার কোনোটি ছিল অস্পষ্ট। তিনিও মারা যাওয়ায় পুলিশকে কৌশলী হয়ে তদন্ত করতে হচ্ছে। কোনো সন্দেহকেই উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।’
দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেল বলেন, ‘আমরা সত্যটা জানতে চাই। এ জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে আমরা দিচ্ছি।
‘জমিতে সেচ দিতে পারছে না এমন কোনো অভিযোগ আমাকে আগে কেউ দেয়নি। অভিনাথের পরিবারের পক্ষ থেকে সেচের বিষয়টি বলা হচ্ছে। কিন্তু রবির সঙ্গে সেচের কোনো বিষয় নেই।’
হাসপাতালে ভর্তির পর রবি নিজেই বলেছিলেন যে তিনি বিষপান করেছেন। সে কারণে পরীক্ষা করে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। তাকে বিষপানের চিকিৎসাই দেয়া হচ্ছিল।
রবির মৃত্যুর বিষয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক শামীম ইয়াজদানী বলেন, “রবি হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ছিলেন। শুক্রবার রাত ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ডেথ সার্টিফিকেটে ‘পয়জনিং’ উল্লেখ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তির পর রবি নিজেই বলেছিলেন যে তিনি বিষপান করেছেন। সে কারণে পরীক্ষা করে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। তাকে বিষপানের চিকিৎসাই দেয়া হচ্ছিল।’
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক দিক নিয়েই পুলিশ কাজ করছে। ঘটনাটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেই তদন্ত করা হচ্ছে।’
রামেক হাসপাতালে গত বৃহস্পতিবার রবির ভাই সুশিল মারাণ্ডির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘রবি বুধবার সন্ধ্যার পর বাড়িতে এসে তার মাকে বলেন, আমি মনে হয় আর বাঁচব না। কী হয়েছে জানতে চাইলে রবি বলেন, আমি বিষ খেয়াছি। কারণ জানতে চাইলে বলেন, জানি না। এরপর ওই রাতেই তাকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
আমরা একটা হিসাব মেলাতে পারছি না যে এখনও জমিতে অস্বাভাবিক খরা দেখা দেয়নি। জমি নষ্ট হয়ে যাওয়া, পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। এরপরও তদন্তে যেটা উঠে আসবে সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সুশিল জানান, রবি ও অভিনাথ দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। তারা নিয়মিত মদপান করতেন। ওই দিনও তারা মদপান করেছিলেন কি না এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘তবে তাড়ি বা মদ যা-ই হোক কিছু একটা ওরা খেয়েছিল।’
সুশিল বলেন, ‘আমাদের জমি দেখাশোনা করত রবি। ওই দিন জমি সেচ দেয়ার কোনো বিষয় ছিল না বলেই শুনেছি। তবে কোন কারণে এমন ঘটনা ঘটল সে বিষয়ে কোনো ধারণা করতে পারছি না।’
এদিকে জমিতে সেচ দিতে নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত কোনো অনিয়ম করেছেন কি না তদন্ত করছে বিএমডিএ।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ বলেন, ‘বিএমডিএ গোদাগাড়ীর সহকারী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্তে অপারেটরের কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘আমরা একটা হিসাব মেলাতে পারছি না যে এখনও জমিতে অস্বাভাবিক খরা দেখা দেয়নি। জমি নষ্ট হয়ে যাওয়া, পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। এরপরও তদন্তে যেটা উঠে আসবে সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’