নীলফামারীর ডোমার এবং মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান বর্জন করেন নীলফামারীর ডোমার উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এ সময় তারা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে চলে যান।
শনিবার সকালে ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান চলাকালে ওই ঘটনা ঘটে।
তবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, যার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন গত নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। পরাজিত শক্তিই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে।
সূত্র জানায়, জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আগে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নুরন নবী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক জাতীয় পতাকা উত্তোলনে আপত্তি জানান। এ নিয়ে হট্টগোল শুরু হয় সেখানে। একপর্যায়ে বর্জনের ডাক দিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন তারা।’
ঘটনাস্থলে থাকা জেলা পরিষদ সদস্য আতাউর রহমান সাজু বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধারা ইউএনও স্যারের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যানকে দিয়ে পতাকা উত্তোলন না করার দাবি জানান। এ সময় প্রতিবাদ জানান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ। একপর্যায়ে হট্টগোল শুরু হলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা চলে যান।’
নুরন নবী অভিযোগ করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। জাতীয় পতাকায় স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তানের হাত লাগুক আমরা তা চাই না। তাই অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেছি।’
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, তোফায়েল আহমেদের বাবা শওকত আলী সরকার একজন রাজাকার। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় তোফায়েলের বাবা শওকত আলী ১০২৫, দাদা চাটি মামুদ ১০৬১ এবং নানা ছমির উদ্দিন সরকারের নাম ১০২৪ সিরিয়ালে আছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদই শেষ পর্যন্ত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরন নবী গত নির্বাচনে আমার কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকে আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। আমার বাবা স্বাধীনতাবিরোধী নন।’
স্থানীয় সাংবাদিক আবু ফাত্তাহ কামাল পাখি জানান, জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান বর্জন করলেও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংবর্ধনা প্রদান করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এখানে উপস্থিত ছিলেন না উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
এর আগে ২০১৯ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
এদিকে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান বর্জনও করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
শনিবার সকালে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানসহ দিনব্যাপী নানা আয়োজন ছিল প্রশাসনের। কিন্তু সমন্বিত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি অমুক্তিযোদ্ধাদের নিমন্ত্রণ করায় অনুষ্ঠান বর্জন করে গাংনী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের তথ্যমতে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাপ্রাপ্তদের মধ্যে ভাতাবঞ্চিতদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় মেহেরপুর জেলার তিনটি উপজেলার ৮৪৬ জন ভাতা বঞ্চিত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে গাংনী উপজেলার ৩৪৫ জনের নাম আছে। তাদের নিমন্ত্রণ করায় আপত্তি তোলেন ভাতা সুবিধাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা।
তবে প্রশাসন বলেছে, প্রশাসনের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যন্তরীণ।
বর্জনের বিষয়ে গাংনী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের উপদেষ্টা নজরুল ইসলাম জানান, স্বাধীনতা দিবসে উপজেলা প্রশাসন এক সংবর্ধনার আয়োজন করে। এ অবস্থায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দাবি তোলেন, যারা গেজেটভূক্ত মুক্তিযোদ্ধা নন, তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া হবে না। তারা তাদের গেজেট নিয়ম অনুযায়ী প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। তার পরও অনুষ্ঠানে গেজেটভুক্ত নন এমন মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত থাকায় গেজেটপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা বর্জনের ডাক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেই অনুষ্ঠানটি বেলা আড়াইটায় শেষ হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহাজ উদ্দীন জানান, ‘প্রশাসনের আয়োজিত অনুষ্ঠান শুধু বর্জনই নয়, তাদের সংবর্ধনা এবং খাবারও গ্রহণ করা হয়নি। তবে যেহেতু প্রশাসনের লোকজন মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে এসে সংবর্ধনা দিয়েছেন, সেটি নেয়া হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ জানান, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) কর্তৃক সর্বশেষ যাচাই-বাছাই করা হয়। সে সময় যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি তাদের গেজেট থেকে বাদ দেয়া হয় এবং ভাতা বন্ধ করেও দিয়েছে সরকার। প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি থাকলে কোনো মুক্তিযোদ্ধা ওই অনুষ্ঠানে যাবেন না বলেও জানানো হয়েছিল। তার পরও তারা উপস্থিত থাকায় অনুষ্ঠান বর্জন করে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী খানম জানান, অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধারা না আসায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক, পৌর মেয়র আহম্মেদ আলী, গাংনী থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রশাসনের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে গিয়ে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে না আসার বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যন্তরীণ। প্রশাসনের সঙ্গে তাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই।