গাজীপুরের টঙ্গীতে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের নামে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট করে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে। যদিও আয়োজক হিসেবে খাতাকলমে নাম ছিল ‘মিলগেইট ছাত্র ও যুব সমাজ’।
চাহিদামতো চাঁদা না পেয়ে এক ব্যবসায়ীকে হুমকি দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। আবার ফাইনাল খেলা ও পুরস্কার বিতরণী শেষে ঘটা করে শিল্পী এনে আয়োজন করার পর তাদেরকে প্রতিশ্রুত টাকাও দেয়া হয়নি।
শিল্পীরা টাকা না পেয়ে গভীর রাত পর্যন্ত থানার সামনে অপেক্ষা করেন। পরে ভোরের আগে আগে তারা হতাশ হয়ে ফিরে যান।
টুর্নামেন্টের নাম রাখা হয় ‘শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্মৃতি মিনি ডে নাইট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।’
গত ২১ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীর মিলগেট অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস্ স্কুল মাঠে শুরু হয় এই আয়োজন। ৫৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম সানি ও সিনিয়র সহসভাপতি পারভেজ ঢালি ছিলেন এর নেপথ্যে।
এক মাস চলার পর ২৫ মার্চ হয় ফাইনাল খেলা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ব্যানারে উল্লেখ করা হয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলকে। বিশেষ অতিথি করা হয় গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) ইলতুৎ মিশকে। তবে তারা কেউ সে আয়োজনে উপস্থিত হননি।
চাঁদাবাজির অভিযোগ
টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে ফি নেয়া হয়। প্রতি ম্যাচে দুই দলের কাছ থেকে ফি নেয়া হয় ৪০০ টাকা।
খেলাকে কেন্দ্র করে ওয়ার্ডের বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে স্পনসর দেখানো হয়। টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন দলকে পুরস্কার হিসেবে মোটরসাইকেল এবং রানার্সআপ দলকে ফ্রিজ দেয়া হয়েছে।
এই আয়োজনে এলাকার ব্যবসায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মার্কেটসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা দাবি করার অভিযোগ ওঠে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ধরন বুঝে চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। তবে সর্বনিম্ন চাঁদা ঠিক করা হয় ৫০০ টাকা।
মিলগেইট এলাকার ব্যবসায়ী আব্বাস উদ্দিন জানান, এক সপ্তাহ আগে ছাত্রলীগ নেতারা একটি দাওয়াত কার্ড দিয়ে যান। এরপর বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহিম সানি চাঁদার টাকা নিতে আসেন।
‘এ সময় বৃষ্টি নামে আমার এক আত্মীয় দোকানে ছিল। সে তাকে ৫০০ টাকা দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে গালাগাল করেন। খবর পেয়ে আমি দোকানে আসি। পরে এক হাজার টাকা দেই। কিন্তু টাকার পরিমাণ তাদের মনমতো না হওয়ায় ছাত্রলীগ নেতারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং টুর্নামেন্টের পর আমাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন’- বলেন আব্বাস উদ্দিন।
মিলগেইট ছাত্র ও যুবসমাজের নামে টুর্নামেন্টের নেপথ্যে ছিলেন কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান সামনে রেখে চাঁদাবাজি করে থাকে, এটি নতুন কিছু নয়। তবে এ বছর ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ঘিরে যেভাবে চাঁদা আদায় করা হয়েছে, এর আগে কখনো এ রকম হয়নি।
টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী দল গাজীপুর ট্রান্সপোর্ট যুব সংঘের অধিনায়ক সোহেল আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গ্রুপ পর্ব থেকেই একের পর এক বিতর্ক জন্ম দিয়ে এসেছে আয়োজক কমিটি। ওয়াকওভার দেয়ার পর আবার ম্যাচ খেলানো, কোয়ার্টার ফাইনালে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন বনাম গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন খেলার ফিক্সচার গঠন, কমিটির টিম অলিম্পিয়া হেরে যাওয়ার পরও তাদেরকে সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ দেয়াসহ একাধিক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়েছে আয়োজক কমিটি। এ জন্য স্বেচ্ছায় আমরা টুর্নামেন্ট বর্জন করেছি।’
শিল্পী ভাড়া এনে টাকা না দিয়ে লাপাত্তা
শুক্রবার টঙ্গীর অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস্ স্কুল মাঠে হয় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া করে আনা হয় শিল্পী ও মিউজিশিয়ানদের। রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীদের পাওনা না মিটিয়ে আয়োজকরা ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান।
ছাত্রলীগ নেতাদেরকে না পেয়ে ভুক্তভোগীরা বিষয়টি সমাধানের জন্য গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতির বাসভবনে যান। পরে তারা রাত ৪টা পর্যন্ত টঙ্গী পূর্ব থানার সামনে অপেক্ষা করেন।
টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী শেষে গান পরিবেশন করেন ‘নগর ব্যান্ড’ এর শিল্পীরা। কিন্তু তাদেরকে টাকা দেয়া হয়নি
ভুক্তভোগী নগর ব্যান্ডের প্রধান রবিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ২৩ হাজার টাকা চুক্তিতে মিউজিশিয়ান ও শিল্পীদের ভাড়া করে আয়োজক কমিটি। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকরা কাউকে কিছু না বলেই টাকা না দিয়ে চলে যান।
‘বিষয়টি নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমানের বাসভবনে বিচার দিতে গিয়েছিলাম। রাত ৪টা পর্যন্ত আমাদের মেয়ে শিল্পীগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তারা (আয়োজক) আমাদের একটা টাকাও দিল না।’
অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করা মিতুয়া বলেন, ‘আমি মিরপুর থেকে এসেছি। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা রাত ১১টায়, কিন্তু হয়েছে ১২টা পর্যন্ত। অনুষ্ঠান শেষে আমাদেরকে বসতে বলে আয়োজক কমিটি চলে গেছে। একজন নারী শিল্পী হয়ে রাত ৩টায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। তারা আমাদের পারিশ্রমিক দেয়নি, অগ্রিম টাকাও দেয় নাই। এখন বাসায় যাওয়ারও অবস্থা নাই।’
ক্ষুব্ধ দলের নেতারাই
আহসানউল্লাহ মাস্টার ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বাবা। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ৭ মে তাকে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। তিনি খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, যাকে এখনও টঙ্গীবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতার নামে ক্রিকেট টুর্নামেন্টকে ঘিরে এতসব অভিযোগে ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই।
৫৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা যারা অরিজিনাল আওয়ামী লীগের লোক তাদের কাউকে বলে নাই। তাদের নিজেদের মতো করে আমাদের নাম দিয়ে দিছে, কিন্তু আমরা বিতর্ক করি নাই। কারণ, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের নামটা জড়িত এখানে। আমরা তার প্রতি দুর্বল। তবে তারা (আয়োজক) যে কাজটা করছে, এটা জঘন্য হয়েছে। চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ীকে হুমকি দিয়েছে। শিল্পী ভাড়া এনে টাকা দেয়নি। এটা কোনো কথা হলো?’
ফাইনালের প্রধান অতিথি করা হয়েছিল ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে। তবে তিনি সেই আয়োজনে যাননি
একই ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি দ্বীন মোহাম্মদ নীরব বলেন, ‘টুর্নামেন্টের বিষয়ে আমাকে কেউ জানায়নি। কার্ডে বিএনপি নেতাদের নাম ঠাঁই পেলেও ওয়ার্ডের বড় বড় আওয়ামী লীগ নেতার নাম নেই। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আমি বিষয়টি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মহোদয়কে জানাব।’
টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোশিউর রহমান সরকার বাবু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু স্ট্যাটাস দেখে আমি ৫৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম সানিকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু তার ফোন বন্ধ ছিল। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার আমাদের আবেগ ও অনুভূতির জায়গা। উনার নামে টুর্নামেন্ট আয়োজন করে কেউ অপকর্ম করলে বরদাস্ত করা হবেনা। আমরা অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
অভিযোগ শুনেই ফোন কাটেন ছাত্রলীগ নেতা
অভিযোগের বিষয়ে জানতে টুর্নামেন্টের আয়োজক কমিটির সদস্য ৫৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম সানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ফাইনাল খেলা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সভাপতি টঙ্গী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মনির হোসেন বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। রাতে তো টাকা পরিশোধ করার কথা।’
তিনি বলেন, ‘শিল্পীদের টাকা দেবে না কেন? ভিটাবাড়ি বিক্রি করে হলেও টাকা দিতে হবে। শিল্পীদের আমার কাছে পাঠান, ওদের বাড়ি বিক্রি করে হলেও আমি টাকা পরিশোধ করিয়ে দেব।’
টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম বলেন, ‘এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ হয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’