৫১ বছরের বাংলাদেশ যেন বৈষম্য, দুর্নীতিমুক্ত হয়, সে প্রত্যাশা করেছেন মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে শনিবার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানায় জাতি। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সন্তানরা।
দিনের শুরুতেই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা।
ভোর ৫টা ৫৬ মিনিটে রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পরপরই শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা।
ওই সময় সশস্ত্র সালাম জানায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সুসজ্জিত চৌকস দল; বেজে ওঠে বিউগলের করুণ সুর।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সভাপতি হিসেবে আরও একবার শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে ছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ ও কেন্দ্রীয় নেতারা।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ১৪ দল। এরপর শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে স্মৃতিসৌধে আসা বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধা জানান।
রাষ্ট্রীয় আয়োজন শেষে স্মৃতিসৌধ খুলে দেয়া হয় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে বিনম্র চিত্তে স্মরণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের।
করোনাভাইরাস মহামারি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিতে জোর দিয়েছে সরকার। তাই স্মৃতিসৌধ আমন্ত্রিত অতিথিদের ভোর ৫টা ২০ মিনিটের পরিবর্তে সোয়া ৭টায় আসার অনুরোধ জানায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
করোনা সংক্রমণের তীব্রতা কমে যাওয়ায় ভোর থেকে স্মৃতিসৌধে ভিড় করেন শ্রদ্ধাবনত হাজারো মানুষ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে জাতির যে বীর সন্তানেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের স্মরণ করছে গোটা দেশ।
দীর্ঘ ৫১ বছরের যাত্রায় দেশের ঝুলিতে অনেক অর্জন থাকলেও অনেক প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ রয়ে গেছে। পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেয়ার তাগিদ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘জাতির পিতাকে হারানোর পর জাতির অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। এই দীর্ঘ ৫১ বছরের পথপরিক্রমায় খুব কম সময়ই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকার ক্ষমতায় ছিল। এটা সত্য এখন বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ও তার পরিকল্পনার আলোকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা একান্ত প্রত্যাশিত। ২০৪১ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যে স্বপ্ন, এটি বাস্তবায়ন হবে যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে।
‘উন্নয়নে পথে বাধা দুর্নীতিকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। উন্নয়নের পথে নানা বাধা-বিপত্তি রয়েছে, তবে এটি সত্য যে, এগুলোর পেছনে যখন সৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে, তখন এই প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করা সম্ভব। বাংলাদেশ যতটুকু পথ অতিক্রম করেছে, এটিও কিন্তু বন্ধুর ছিল। সামনেও হয়তো এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকবে, কিন্তু যখন আমাদের সামনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থাকবে, তখন এসব অতিক্রম করা কঠিন কিছু হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এখনও অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ আছে তাদের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে হবে। এর জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছানোর বিকল্প নেই।’
দেশকে লুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাকিস্তানের সময় আমরা সংগ্রাম করেছিলাম এক দেশে দুই অর্থনীতি মানি না। এখনও বাংলাদেশে দুই অর্থনীতি চলছে। এটাকে প্রতিহত করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে আমাদের জন্য আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু।
‘বাংলাদেশ খুড়িয়ে চলছে। কারন এখনও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে পারেনি, লুটপাটতন্ত্র নির্মূল করতে পারেনি, বৈষম্য দূর করতে পারেনি। যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল, দুটোই আজ নির্বাসিত। সুতরাং এই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া আমাদের সামনে কোনো পথ নেই। বড় চ্যালেঞ্জ হলো লুটপাটের হাত থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা। দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে উদ্ধার করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় এবং সমাজতন্ত্রের ধারায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়া। এটাই স্বাধীনতা দিবসের অন্যতম অঙ্গীকার।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষক বিজয় কুমার শীল অবশ্য দেশকে নিয়ে আশার কথাই শোনালেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো সব সময়ই ভালো বাংলাদেশ চাই। আজ বাংলাদেশ ৫০ বছরে যে অবস্থায় এসেছে, আশা করি ভবিষ্যতে এ ধারা ধারাবাহিকতা থাকবে এবং একদিন উন্নত দেশে পরিণত হবে, তবে এটা সত্য যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়েও মানুষের উন্নয়ন প্রয়োজন আছে। এটাই প্রত্যাশা করি।’
‘দ্রব্যমূল্য যেন থাকে হাতের নাগালে’
সিআরপি থেকে হুইল চেয়ারে করে স্বাধীনতা দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন সৈকত। দেশের কাছে প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা সবকিছু যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। না হলে এত চড়া দামে কোনো কিছু কেনাকাটা করার এবিলিটি আমাদের নেই।
‘এমনিতেই জীবনের সাথে আমাদের অনেক যুদ্ধ করতে হচ্ছে। প্রতি মাসে আমাদের ঔষধসহ আনুষঙ্গিক অনেক খরচ গুনতে হয়। তার ওপর যদি দ্রব্যমূল্য এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে তো জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।’
দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন বিশ্বে নজির স্থাপন করতে পারে এই প্রত্যাশার কথা জানান রাজবাড়ী থেকে আসা ধনঞ্জয় কুণ্ডু। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনও বাংলাদেশে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সাম্প্রদায়িক হামলা লেগেই আছে। এ জন্য আমি চাই আগামীতে বাংলাদেশ যেন একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এখনও দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে দুর্নীতি রয়েছে।
‘আর এ কারণে, সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। এটা যাতে আর না হয়।’
দেশ নারীর জন্য সুরক্ষিত হবে এই কামনার কথা জানান শ্যামলী নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান। তিনি বলেন, ‘শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। আমাদের প্রত্যাশা হলো আমরা যে স্বাধীন দেশ পেয়েছি, এটা যেন আসলেই স্বাধীন থাকে। সেখানে যেন আমরা নিরাপদে চলাচল করতে পারি। বিশেষ করে নারীরা আমরা এখনও স্বাধীন না। আমরা যেন আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অর্জন করতে পারি এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
‘বাংলাদেশটা যেভাবে চলছে এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখে উন্নত হবে এবং আমাদের জন্য অর্থাৎ নারীদের জন্য আরও সুরক্ষিত একটি বাংলাদেশ হবে।’