মানবাধিকার ইস্যুতে জাতিসংঘের রেজুলেশনে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। কোনো চাপের মুখে নয়। বাংলাদেশ সব সময় যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল, আছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত সেমিনারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
মোমেন বলেন, ‘যেকোনো যুদ্ধে সাধারণ নাগরিক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি।
‘জাতিসংঘের রেজুলেশনে বলা হয়েছে, যারা নির্যাতিত এবং আহত হয়েছেন তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য। যেহেতু আমরা চাই, যারা নির্যাতিত হয়েছেন তারা সব ধরনের সুবিধা পাক, সে জন্য আমরা এ রেজুলেশনে রাজি হয়েছি।’
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সভায় ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সমালোচনা করে প্রস্তাব আনা হয়। জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে বেসামরিক নাগরিক, স্বাস্থ্যকর্মী, সাহায্যকর্মী, সাংবাদিক, হাসপাতাল ও বেসামরিক স্থাপনার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে।
এর আগে ২ মার্চ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের আনা একটি প্রস্তাবে ভোট দেয়া থেকে বিরত ছিল বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘে পশ্চিমা দেশের পক্ষ থেকে একটি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে আরেকটি রেজুলেশন এসেছিল এবং দুটোই মানুষের মঙ্গলের জন্য আনা হয়েছিল। বাংলাদেশ উভয় রেজুলেশনে সম্মত হয়েছে। কিন্তু সাউথ আফ্রিকার রেজুলেশন পর্যাপ্ত সমর্থন না পাওয়ার কারণে ভোট দেয়া হয়নি।
‘গত ২ মার্চের রেজুলেশন একতরফা ছিল এবং সেখানে শুধু রাশিয়াকে দোষারোপ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু যুদ্ধ তো এক হাতে হয় না, এক হাতে তালি বাজে না। এখানে অন্য পক্ষের নামই আসেনি। সে জন্য আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, এটি অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট এবং এটিতে যুদ্ধ থামবে না।’
যুদ্ধ থামাতে হলে উভয় পক্ষকে আন্তরিকতার সঙ্গে সামনে আসতে হবে। কিন্তু আগেরটাতে মনে হয়েছিল এক পক্ষকে দোষারোপ করা হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার একজন প্রতিনিধি সম্প্রতি বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধতে আমাদের জোর করে অংশীদার করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব তাদের দাবা খেলার রাজনীতিতে আমাদের জোর করে টেনে আনার চেষ্টা করছে, যা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি তিনি ভালো কথা বলেছেন।’
‘আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধে অংশীদারও হতে চাই না।’
বর্তমানের যুদ্ধ শুধু সেনা দিয়ে হয় না, অর্থনৈতিকভাবেও হয় বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ধরনের বিষয় চিন্তা করছি। দেখা যাক কী হয়। কারণ, আমাদের মনে হচ্ছে এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে এবং এটি গোটা বিশ্বের যে আর্কিটেকচার সেটি পরিবর্তন করতে পারে।
‘এটি ভালো হবে না মন্দ হবে সেটি জানি না। তবে যে বিশ্বাসের জায়গার ওপরে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল, সেটিতে একটি বড় ধরনের আঘাত আসবে।’
একাত্তরের গণহত্যার বিষয়ে মোমেন বলেন, ‘একাত্তরের গণহত্যা পাকিস্তানের জন্য লজ্জাজনক। তাদের নতুন প্রজন্ম এ অপরাধ অনুধাবন করবে। তারা লজ্জা ও দুঃখ প্রকাশ করবে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোমেন বলেন, ‘অপারেশন সার্চলাইট, ৩০ লাখ মানুষকে হত্যার ঘটনা এবং ধর্মের নামে, রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীর কারণে নির্দোষ মানুষকে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ শুরু থেকেই নির্যাতিত মানুষের পক্ষে অবস্থান ধরে রেখেছে। সেখান থেকেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। পাঁচ বছরেও তাদের ফেরানো যায়নি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে এখন পর্যন্ত নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। তাদের ফেরাতে নিরাপদ পরিবেশ ফিরিয়ে আনেনি মিয়ানমার জান্তা সরকার।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি রোহিঙ্গা বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মধ্যে এখনও দেখা যায়নি। বিশ্বে এখনও গণহত্যা থেমে নেই। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠানগুলোর এ বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়া উচিত।
‘সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ করে, শান্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা চায় বাংলাদেশ। মানুষের বাইরে কোনো কিছু হতে পারে না। গণহত্যা এখনই বন্ধ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে গণহত্যা গবেষক ড. হেলেন জারভিজ বলেন, ‘১৯৭১ গণহত্যাকে ৫০ বছরেও স্বীকার করেনি পাকিস্তান। আজও একজন পাকিস্তানি এ নৃশংসতার জন্য বিচারের মুখোমুখি হননি। ইতিহাসের এটা এক কালো দিক।’
জাতিসংঘের প্রিভেনশন অব জেনোসাইড বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা এলিক ওয়াইরিমু এনডেরিটু বলেন, ‘বিশ্বের মানুষকে গণহত্যার বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। সেটা যে স্থান ও যে অবস্থানেই হোক না কেন। মানুষ হিসেবে পূর্বের প্রত্যেকটি ঘটনাকে পুনরায় মূল্যায়ন করতে হবে। বিচারের মুখোমুখি করে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে হবে।’
বাংলাদেশ সব গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে প্রশংসা করেন তিনি।
জেনোসাইড ওয়াচের ফাউন্ডিং প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক গ্রেগরি স্টানটন বলেন, ‘গণহত্যা এখনও বিশ্ববাসীর কাছে বড় হুমকি। জাতিসংঘ একাই এর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। সদস্য রাষ্ট্র সবারই দায়িত্বশীল ভূমিকায় থাকতে হবে।’
২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের দাবি
সেমিনারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ন্যূনতম মানবাধিকার রক্ষা না করে, অন্যান্য দৌড়ের ঘোড়ার মতোই দৌড়াচ্ছি। কোথাও কোনো ভিন্নতা নেই। একজন মানুষকে হারানো মানেই অনেক বড় ক্ষতি। যেকোনো মূল্যেই এর অবসান ঘটাতে হবে।’
এ জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে বলে মত দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘৭ হাজার নয়, কমপক্ষে ২৫ হাজার মানুষকে অপারেশন সার্চলাইটের নামে হত্যা করা হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। একাত্তরের শরণার্থীদের মতোই এই মানুষগুলো বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এত মানুষের দায়িত্ব বহন করবে আশ্রয়দাতারা। যারা হত্যা করছে তাদেরকে কি কোনোভাবেই জবাবদিহির আওতায় আনা হবে না? এই মানুষগুলোকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। হারানো সব সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে।’
৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানান তিনি। বলেন, ‘বাংলাদেশের পার্লামেন্টে পাস হলেও জাতিসংঘের ভোটাভুটির দরকার। রাষ্ট্রগুলোর মনোভাবের পরিবর্তন হচ্ছে।’
খুব শিগগির এটা ২৫ মার্চ পালিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী।