ডায়রিয়া ও কলেরা রোগের চিকিৎসায় দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল পরিচালনা করে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআর,বি। প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পর হাসপাতালটিতে ডায়রিয়া আক্রান্ত সর্বোচ্চ রোগী আসছে এবার।
রাজধানীর মহাখালীর এই হাসপাতালে গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনই ১ হাজার ২০০-এর বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। এক দিনে এত রোগী এর আগে কখনও দেখেননি হাসপাতালের কর্মীরা।
গরম পড়তে না পড়তেই রাজধানীতে এ রোগের প্রকোপের পেছনে বেশ কিছু কারণকে সামনে এনেছেন আইসিডিডিআর,বির একজন চিকিৎসক।
তিনি বলেন, করোনার প্রকোপের সময় মানুষ রাস্তার ধারে খোলা খাবার কম খেয়েছে। পাশাপাশি বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছে। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতেই আবার আগের চিত্র ফিরে এসেছে।
অন্য অনেক কারণের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণকেও দায়ী করছেন আরেকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জরিপের তথ্য বলছে, পরিবেশ দূষণে দেশের হিসাবে বাংলাদেশ শীর্ষে আর শহর হিসাবে ঢাকা তৃতীয়।
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দিতে শুক্রবার থেকে দ্বিতীয় তাঁবু তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ছবি: নিউজবাংলা
এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন, দেশে রাস্তার পাশে খোলা খাবার খাওয়ার প্রবণতা আছে। বাতাসে দূষণ বেশি হওয়ায় এসব খাবার জীবাণু আক্রান্ত হচ্ছে।
২০১৮ সালেও ঢাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। সে সময় দিনে গড়ে এক হাজারে মতো রোগী ভর্তি হয়েছিল। এর আগে ২০০৭ সালে বন্যার সময় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সেই সময়ে দৈনিক রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল এক হাজারের মধ্যে।
আইসিডিডিআর,বি বলছে, গত ১৬ মার্চ ১ হাজার ৫৭ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়। পরদিন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪১ জনে। ২০ মার্চ রোগীর সংখ্যা হয় ১ হাজার ১৫৭, ২১ মার্চ ১ হাজার ২১৬, ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২ ও ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন।
রাজধানীর ঘিরে রাখা জেলাগুলো থেকে রোগী আসছে বেশি। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কদমতলী, দক্ষিণখান, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকেও রোগী আসছে বেশি।
রাজধানীর বাইরের এলাকার মধ্যে বেশি রোগী সাভার, গাজীপুর ও ময়মনসিংহের।
হাসপাতালের শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় তাঁবু টানিয়ে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে আইসিডিডিআর,বি। শয্যা আরও বাড়িয়ে শুক্রবার থেকে দ্বিতীয় তাঁবু তৈরির প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে।
হাত ধোয়া ‘ভুলে’ ভুগছে মানুষ
হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক বাহারুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে দুই বছর তাঁবু তৈরির প্রয়োজন হয়নি। তখন মানুষ খুব বেশি রাস্তায় বের হয়নি, রাস্তার খোলা খাবারের দোকানগুলো বন্ধ ছিল। মানুষের মধ্যে হাত ধোয়ার প্রবণতাও বেশি ছিল। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কমে এসেছে। যে কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে।’
দায় পরিবেশ দূষণেরও
শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমও রাস্তার পাশে খোলা খাবারের পাশাপাশি দায়ী করেছেন পরিবেশ দূষণকে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দূষিত বায়ুর দিক থেকে বাংলাদেশ প্রথম হয়েছে। শহর হিসেবে ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এটিও রোগী বাড়ার একটি কারণ মনে হয়েছে আমাদের কাছে।’
শিশুদের চিকিৎসায় গড়ে তোলা এই হাসপাতালে পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সতর্ক আছেন জাহাঙ্গীর আলম। বলেন, ‘কলেরা হাসপাতালে রোগী বেড়েছে সেটা দেখেই আমাদের হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছি।’
প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত সর্বোচ্চ রোগী আসছে এবার। ছবি: নিউজবাংলা
আইসিডিডিআর,বিতে আসা রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই প্রাপ্তবয়স্ক ও পুরুষ। শিশুর সংখ্যা বেশ কম।
কেবল এই হাসপাতাল নয়, ঢাকা শিশু হাসপাতালেও ডায়রিয়া রোগীর চাপ এখনও কম।
গত ২৪ ঘণ্টায় এই হাসপাতালে ১০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। মোট ভর্তি ১০০ জনের নিচে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকার কিছু পকেট এরিয়ায় ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। রোগীর সেবা দিতে হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন, কলেরা শনাক্তকরণ কিটসহ সব উপকরণ পর্যাপ্ত আছে।’
যা করতে হবে, কী করা যাবে না
ডায়রিয়া প্রতিরোধে বাইরের খাবার না খাওয়া ও পানি ফুটিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘তীব্র গরমে মানুষ বাইরে শরবত, আখের রস খাচ্ছে। বাড়িতেও পানি ফুটিয়ে খাচ্ছে না অনেকেই।
‘কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্কুল-কলেজ সবকিছু খুলে যাওয়ায় মানু্ষ বাইরে যাচ্ছে বেশি এবং খোলা খাবার খাচ্ছে। এসব কারণে মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বাইরের খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। ঘরের বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। খাবার দীর্ঘক্ষণ বাইরে রেখে তারপর ফ্রিজে রেখে খাওয়া যাবে না। রান্নার পরপরই ফ্রিজে রেখে দিতে হবে।
‘যদি কেউ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাহলে স্যালাইন ও ডাবের পানি খেতে হবে। তা না হলে ডিহাইড্রেশনের কারণে কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
শিশু হাসপাতালের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গোসলের সময় শিশুরা যেন পানি না খায়, এটি দেখতে হবে।’