রাশিয়ার আর্থিক লেনদেনের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞার কারণে সুইফট সিস্টেমের বাইরে গিয়ে চীনের মুদ্রা বা দুই দেশের জাতীয় মুদ্রা টাকা ও রুবলে বিনিময় করা যায় কি না সেটি বিবেচনা করছে ঢাকা ও মস্কো। এ বিষয়ে দুই দেশ কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ম্যানটিটস্কি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে রাশিয়ান হাইকমিশনে আয়োজিত ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের এক মাস: কারণ ও ফলাফল’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানান।
উল্লেখ্য, সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) হল ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তব্যাংক আর্থিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের একটি সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক।
জাতীয় মুদ্রার লেনদেন এবং তৃতীয় দেশের ব্যাংক ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে কী কী কাজ করছেন তা বিস্তারিত জানাতে চাননি তিনি।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহে রাশিয়াতে বাংলাদেশ দূতাবাস বার্টার (পণ্য বিনিময়) করা যায় কি না সেটি বিবেচনার প্রস্তাব করেছে। জাতীয় মুদ্রা বা ইউয়ান দিয়ে বাণিজ্য করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সুইফট সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে লেনদেন করা যায় কি না সেটিও পরীক্ষা করা হচ্ছে।
‘বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির ইচ্ছা আছে রাশিয়ার। অনেক পশ্চিমা কোম্পানি তাদের সরকারের চাপের মুখে রাশিয়া ত্যাগ করেছে। এটি বাংলাদেশে যারা আমাদের অংশীদার আছে তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘রূপপুর প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়সীমা অনুযায়ী চলছে। রাশিয়ার অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং এখানে কর্মরত কন্ট্রাকটরদের অর্থ রাশিয়া থেকে দেয়া হচ্ছে। ফলে এই প্রকল্প নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
'রূপপুরের নির্মাণকাজ সময়সূচিতে রয়েছে এবং প্রকল্পটি পূর্বে অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে। সমস্ত অপারেশন সময়সূচি অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস ও গমের মতো পণ্য রপ্তানিতে সম্ভাব্য ব্যাঘাতের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিসহ বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তির দায়িত্বশীল পক্ষ হিসেবে রাশিয়ান ফেডারেশন চুক্তির অধীনে তার দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণভাবে পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট না দেয়ায় কৃতজ্ঞতা
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনে আগ্রাসন শীর্ষক রেজুলেশনে বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থাকায় কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন চাপের মুখেও ভোটের সময়ে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখায় আমরা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন খুব সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের বিরত থাকার পেছনের উদ্দেশ্যগুলোকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সুতরাং, আমার আর কিছু যোগ করার নেই।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি হুমকি সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার তেল কেনার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। তারা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাস্তবসম্মত পন্থা অবলম্বন করেছে।’
রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপের কারণে অনেক পশ্চিমা কোম্পানি রাশিয়ার বাজার ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সব খাত বাংলাদেশি কোম্পানি দ্বারা পূর্ণ হতে পারে বলে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আশা জানান।
দাম বাড়ছে রুবলের
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান নিয়ে যেসব পশ্চিমা দেশ রুশবিরোধী অবস্থান নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে রাশিয়া। মস্কো সাফ জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দেশগুলোকে রুশ মুদ্রা রুবলেই রাশিয়ার গ্যাস কিনতে হবে।
এমন ঘোষণার পরই, বুধবার সর্বশেষ তিন সপ্তাহে ডলারের বিপরীতে রুশ মুদ্রার দাম সর্বোচ্চ হয়েছে। এরই মধ্যে ১ ডলারের বিপরীতে ১০০-এর নিচে নেমে ৯৫-এ স্থির হয়েছে রুবল। ইউরোর বিপরীতেও দাম বেড়েছে ৩.৫ শতাংশ। প্রতি ইউরো এখন বিনিময় হচ্ছে ১১০.৫ রুবলে।
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে এই মাসের শুরুর দিকে রুশ মুদ্রা রুবলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবনমন হয়েছিল। গত মার্চের ৭ তারিখে প্রতি ডলারে ১৩২ রুবল ও ইউরোতে ১৪৭ রুবলে নেমে আসে। যেখানে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ডলারের বিপরীতে ছিল ৭৫ রুবল ও ইউরোর বিপরীতে ছিল ৮৫ রুবল।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ রুশ সম্পদ জব্দ করার অবৈধ সিদ্ধান্তের কারণে তাদের মুদ্রার ওপর আস্থা নষ্ট হয়েছে। তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দেশগুলোকে রুবলে গ্যাসের দাম পরিশোধ করতে হবে।
এ-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। বেঁধে দিয়েছেন ১ সপ্তাহ সময়।
যদিও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার। পুতিন জানিয়েছেন, চুক্তিতে নির্ধারিত মূল্যতেই গ্যাস সরবরাহ করবে রাশিয়া। শুধু অর্থ প্রদানে মুদ্রার পরিবর্তন হবে।
তবে শুধু গ্যাসের বিষয়েই নয়, অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই পন্থায় হাঁটবে রাশিয়া। পুতিন বলেন, ‘আমাদের পণ্য ইইউ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে ডলার বা ইউরোতে লেনদেনের কোনো মানে হয় না।’
এদিকে বুধবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মেগাওয়াট গ্যাসের দাম ৯৭ ইউরো থেকে বেড়ে ১০৮.৫ ইউরোতে পৌঁছায়। রুশ প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর তা আরও ১০ ইউরো বেড়ে যায়।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ তাদের মিত্র দেশগুলো মস্কোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, লেনদেনে ডলার এবং ইউরো সীমিত করেছে। বিদেশে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলার জব্দ করা হয়েছে। যদিও রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছে এসব দেশ।