নওগাঁ পৌরসভায় বেড়েছে মশার উপদ্রব। শহরজুড়ে এ যেন মশার রাজত্ব। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও মিলছে না রেহাই। মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা।
শহরের এখানে-ওখানে খানাখন্দ; এ ছাড়া খোলা ম্যানহোল, পয়োনালা, নির্মাণাধীন ভবন সব যেন মশার আবাসস্থল। এসব জায়গায় মশা বংশ বিস্তার করে চলেছে। এতে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে পৌরবাসী।
একই দশা নওগাঁয়ও। পৌর শহর, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, মাধবদী বাজার, ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ও বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাসাবাড়িতে মশার উপদ্রব বেড়েছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মশার উৎপাত বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
স্থানীয়রা বলছেন, পৌরসভার নালায় অপরিষ্কার পানি জমা, নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করা এবং যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে মশা বাড়ছে। আর মশকনিধনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক কার্যক্রমের অভাবে মশার বিস্তার চরম আকার ধারণ করেছে বলে দাবি তাদের। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মশানিধনে যেন আরও বেগবান হয়, সে আশা জনসাধারণের।
তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, মশার বংশবিস্তার রোধে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ছিটানো হচ্ছে ওষুধ, দেয়া হয়েছে বিভিন্ন নির্দেশনা। এ ছাড়া মশার উৎপাত থেকে বাঁচতে বাসিন্দাদের বাসাবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখাসহ সচেতন থাকার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
নওগাঁ পৌর শহরের তাজের মোড়ের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত প্রায় ৩ মাস থেকে মশার জ্বালাতন সহ্য করতে হচ্ছে। শুধু রাতে না, দিনেও মশার ব্যাপক উপদ্রব। দিনের বেলাতেও মশারি টানিয়ে থাকতে হচ্ছে। মশা নিধনে পৌর কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ দেখছি না।’
পার-নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা ফাতেমা বেগম বলেন, ‘কিছুদিন থেকেই এই উপদ্রব বেড়েছে। ঘরে-বাইরে কোথাও মশা থেকে নিস্তার নেই। মশা নিধনে পৌরসভার পক্ষ থেকে ওষুধ ছিটানোই শুরু হয়নি। বাচ্চাদের দিনে মশারির মধ্যে রাখতে হচ্ছে।’
এতে বিপদ দেখছেন তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মশাজনিত রোগবালাই দেখা দিতে পারে অচিরেই। প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় যদি এমন দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড দেখা যায়, তাহলে আমরা কাদের ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করলাম। তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে আমরা বিপদে আছি।’
শহরের মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা একরামুল হক বলেন, ‘শুধু নামেই প্রথম সারির পৌরসভা। কিন্তু প্রথম সারির পৌরসভার কোনো কর্মকাণ্ড নেই, উন্নয়ন নেই। রাস্তার পাশে, নালায় আর্বজনা, অধিকাংশ স্থানে খোলা ডাস্টবিন। বর্ষা এলেই এসব জায়গায় পানি জমে। এখন শুরু হয়েছে মশার উপদ্রব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে পৌরসভা কৃর্তপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। এক কথায় সব দিক দিয়ে পৌরবাসী আমরা অবহেলিত।’
শহরজুড়ে মশার উপদ্রব বাড়লেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন নওগাঁ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রাজু হোসেন। বলেন, ‘মশার বংশবিস্তার রোধে ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই।’
‘দিন-রাত মশার জ্বালায় ঠিকভাবে পড়ালেখাও করা যায় না। দিনের বেলাতেও কয়েল জ্বালিয়ে, মশারি টানাতে হয়। কয়েলেও কাজ হয় না ঠিকমতো। এগুলো কি পৌরসভা কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে না?’ বলেন তিনি।
জানতে চাইলে এসব অভিযোগের বিপরীত দাবি করলেন নওগাঁ পৌরসভার মেয়র আলহাজ মো. নজমুল হক সনি। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মশকনিধনে ইতোমধ্যে নওগাঁ পৌরসভার প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে তিনটি করে ফগার মেশিনের মাধ্যমে ওষুধ স্প্রে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাশাপাশি হ্যান্ড স্প্রের মাধ্যমেও ড্রেনে মশার লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে।’
অধিকাংশ ওয়ার্ডের বাসিন্দারা বলছেন, কোনো রকম স্প্রে কার্যক্রম শুরু করা হয়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘আসলে অভিযোগটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা মশকনিধনে স্প্রে কার্যক্রম শুরু করেছি। আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যেই পৌরবাসী সুফল পাবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমের আগেই পৌরসভার সব বড় ড্রেন পরিষ্কার করা হয়। এতে বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের কোনো সমস্যা হয় না। ফলে পানি জমে মশার বংশবিস্তারেরও সুযোগ নেই।’
মশার উৎপাত থেকে বাঁচতে বাসিন্দাদের বাসাবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখাসহ সচেতন থাকার পরামর্শ দেন তিনি। ‘বর্তমানে মশার যে উপদ্রব, তা মৌসুমকালীন সমস্যা হতে পারে। মশার বংশবিস্তার নির্মূলে আমরা চেষ্টা করছি। তবে পৌরবাসীর একটু সচেতন হতে হবে, যাতে বাড়ির ছাদে টবে পানি জমে না থাকে। সেই সঙ্গে ময়লা-আর্বজনা যেন নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে।’
এ বিষয়ে নওগাঁ সিভিল সার্জন অফিসের মেডিক্যাল অফিসার আশিষ কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শহরের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ, খোলা ম্যানহোল, পয়োনালা, বাড়ির ছাদ, ফুলের টব, নারকেলের খোসায় পানি জমলে এসব জায়গায় মশা বংশবিস্তার করে থাকে। এ থেকে মানুষ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, এনকেফেলাইটিসসহ মশাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।’
প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘মশার কামড় থেকে আত্মরক্ষাই সবচেয়ে বড় সমাধান। বসন্তকাল থেকে মশাজনিত অসুখ-বিসুখ শুরু হয়, আর বর্ষাকালে প্রকোপ আকার ধারণ করে। মশা থেকে বাঁচতে পাড়ামহল্লার সবাই মিলে বাড়ির চারপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশাবাহিত রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
এদিকে নরসিংদীর সদর উপজেলা মাধবদীর মোস্তাকিম হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন ব্যবসার কাজে শহরে থাকতে হয়। যেখানে বসি মশা হানা দেয়। রাতে বাড়িতে ফিরেও মশা। রাতে ঘুমাতে গেলে অতিষ্ঠ লাগে। পৌর শহরে স্প্রের ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামে তার উদ্যোগ নেয় না কেউ।’
নরসিংদী সরকারি কলেজের সামনে কথা হয় শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম, রোমান মিয়া, শিল্পী আক্তার ও রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে। তারা জানান, ক্লাসের ভিতরে, বাড়িতে, কোচিংয়ে, এমনকি শৌচাগারেও মশার উপদ্রব থাকে। তাই ডেঙ্গু আতঙ্কে আছেন তারা।
নরসিংদী বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে একাধিক বাসচালক ও রেলযাত্রী বলেন, দিনে চলন্ত বাস ও ট্রেনেও মশা কামড়ায়। আর সন্ধ্যা হলে তো স্ট্যান্ডে বসা বা দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। মশার জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ। কর্তৃপক্ষ মশা নিধনে যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।
পৌর শহরের একজন দোকানি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে মশার ওষুধ দিয়ে যায়। এতে কিছু সময়ের জন্য মশা কম থাকে। মশার কামড়ে জীবন অতিষ্ঠ।’
এ বিষয়ে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র মো. আমজাদ হোসেন বাচ্চু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পৌর শহরের প্রতিটা ওয়ার্ডে মশা নিধন স্প্রে প্রয়োগ চলমান রয়েছে। মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে বাসাবাড়িসহ ভবনগুলোর আশপাশ পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে।’
নরসিংদীর সিভিল সার্জন নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের জন্য মশারি ব্যবহারের ব্যবস্থা রয়েছে।’
এ বছর জেলায় ডেঙ্গু জ্বরের তেমন কোনো প্রভাব নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলো পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে বাধ্যতামূলক নির্দেশ দেয়া আছে। সদরের দুটি সরকারি হাসপাতালে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু নাই। তবে এ জেলার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগীর ভর্তি বা পরিসংখ্যান নির্ণয় করে বিস্তারিত জানানো হবে।’